আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল রংপুর যাচ্ছে রোববার

রংপুর জেলার গঙ্গাছড়া উপজেলায় সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রাম পরিদর্শনে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল।

শনিবার দলটির দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বলা হয়, ১৯ নভেম্বর সকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রংপুরের গঙ্গাছড়া উপজেলায় অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রাম পরিদর্শন করবেন।

পরিদর্শনকালে আরও উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ও উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া।

৭ মার্চের ভাষণ লিখিত ছিল না : প্রধানমন্ত্রী

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ লিখিত ছিল না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইউনেসকো কর্তৃক ৭ মার্চের ভাষণকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ডকুমেন্ট স্বীকৃতি প্রদান উপলক্ষে আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক নেতাই অনেক ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণগুলো ছিল লিখিত। একটি মাত্র ভাষণ যার কোনো লিখিত ছিল না। এমনকি নোটও ছিল না। প্রতিটি কথাই তিনি বলে দিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি জাতিকে তিনি জাগ্রত করেছিলেন আন্দোলন-সংগ্রামে। সেদিনের ভাষণের কথা মনে হলেই আমার মনে পড়ে আমার মায়ের কথা।

তিনি বলেন, অনেক লিখিত বক্তব্য বাবার হাতে দেয়া হয়েছিল। মা বাবাকে বলেছিলেন, তুমি সেই কথা বলবে, যা তোমার মনের কথা।

বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে ভাষণ শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বক্তব্যের শুরুতেই স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট নিহত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্য এবং জেলহত্যার শিকার ৪ জাতীয় নেতার প্রতিও শ্রদ্ধা জানান তিনি।

এর আগে শনিবার দুপুর ২টা ৩৯ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। নৌকার আদলে নির্মিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

এর আগে সকাল থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগ, এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক ও ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যানার নিয়ে সমাবেশে আসতে শুরু করে। দুপুরের মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সমাবেশস্থল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের আদলেই সাজানো হয়।

এসময় বাংলা একাডেমি চত্বরে ঢাকা লিট ফেস্টও চলে সুশৃঙ্খলভাবে। তিন দিন ব্যাপি এ উৎসবের আজ শেষদিন। একদিকে নাগরিক সমাবেশ অন্যদিকে চলে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব।

তা‌রেকের জন্ম‌দি‌নে কেক কাট‌লেন খা‌লেদা

গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ৫৩ পাউন্ডের ৭টি কেক কেটে ছেলের জন্মদিন উদযাপন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। রোববার (১৯ নভেম্বর) দিনগত রাত ১২টা ১ মিনিটে এ কেক কাটা হয়। এ সময় নেতাকর্মীরা করতালি ও ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ শ্লোগানে তারেক রহমানকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান।

২০ নভেম্বর (সোমবার) তারেক রহমানের ৫৩তম জন্মদিন। ২০০৮ সাল থেকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে রয়েছেন তারেক রহমান। কেক কাটার পর মোবাইলে ছেলের সঙ্গে কথা বলেন খালেদা জিয়া। পরে দলের মহাসচিবসহ নেতৃবৃন্দরা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান।

কার্যালয়ের ভেতরে নেতৃবৃন্দ অবস্থান নিলেও কেক কাটার মূল অনুষ্ঠান বাইরে বড় পর্দায় দেখানো হয়। এ সময় কার্যালয়ের সামনে সহাস্রাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপি, মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, ছাত্রদলের আলাদা আলাদা ছয়টি বড় আকারের কেক টেবিলে রাখা হয়। রাত ১২টায় ১ মিনিটে কেক কাটেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

এর পর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ কেক কাটেন। এ ছাড়া পরের কেকগুলো পর্যায়ক্রমে অঙ্গসংগঠনের নেতাদের নিয়ে কাটা হয়।

জন্মদিনে কেক কাটার অনুষ্ঠানে অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন কাদের চোধুরী, শওকত মাহমুদ, জয়নাল আবেদীন, আমানউল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, রুহুল কবির রিজভী, মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, মীর সরফত আলী সপু, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বিএনপির অঙ্গসংগঠনের মধ্যে মহানগর দক্ষিণের হাবিব উন নবী খান সোহেল, কাজী আবুল বাশার, উত্তরের মুন্সি বজলুল বাসিত আনজু, আহসানউল্লাহ হাসান, যুব দলের সাইফুল ইসলাম নিরব, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মোরতাজুল করীম বাদরু, স্বেচ্ছাসেবক দলের শফিউল বারী বাবু, আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, সুলতানা আহমেদ, ছাত্রদলের রাজিব আহসান, আসাদুজ্জামান আসাদ প্ুমূখ নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

কেক কাটা শেষে তারেক রহমানের আরোগ্য কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয় এবং কেক ৭টি এতিমখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।

এদিকে তারেকের জন্মদিন উদযাপনে বিএনপি দুইদিনের কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সোমবার (২০ নভেম্বর) সারাদেশে মহানগর ও জেলা সদরে তারেকের আশু আরোগ্য ও সুস্থতা কামনায় দোয়া মাহফিল ও পরদিন শনিবার (২১ নভেম্বর) বিকেলে রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

এ ছাড়া ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) সোমবার সকাল থেকে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে থেকে ‘ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প’ এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা ও বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ করবে।

জন্মদিনে তারেকের সুস্থতা কামনা করে খালেদার টুইট

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৫৩তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে তার সুস্থতা কামনা করেছেন দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে এক টুইটে তারেক রহমানের সুস্থতা কামনা করে শুভেচ্ছা জানান তিনি।

চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান এ তথ্য জানিয়েছেন।

তারেক রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে খালেদা জিয়া তার টুইটে লিখেছেন, ‘শুভ জন্মদিন তারেক রহমান। তুমি সুস্থ ও সুন্দর থাক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণে সফল হও -এ দোয়া করি।’

এর আগে রোববার (১৯ নভেম্বর) দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে তারেক রহমানের জন্মদিনের কেক কাটেন তারেক রহমানের মা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কেক কাটার পর মোবাইলে ছেলের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এ সময় নেতাকর্মীরা করতালি ও ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ স্লোগানে তারেক রহমানকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান।

২০০৮ সাল থেকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে রয়েছেন তারেক রহমান।

গুলশানে উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক ডেকেছেন খালেদা

উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের বৈঠক ডেকেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮ টায় চেয়াপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান এ তথ্য জানিয়েছেন।

এর আগে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস ভাইস চেয়ারম্যান ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন খালেদা জিয়া। ধারাবাহিকভাবে তিনি নির্বাহী কমিটির অন্যান্য নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে।

শান্তিরক্ষা মিশনে সশস্ত্র বাহিনী সুনাম বয়ে আনছে

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কর্মরত আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা কর্মদক্ষতা ও উঁচু মানের পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সোমবার ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ উপলক্ষে গণমাধ্যমে পাঠানো বাণীতে তিনি এসব কথা বলেন।

দেশের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগেও সশস্ত্র বাহিনী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দ্বিধাহীনভাবে সংকট মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া।

তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর সাহস ও শৃঙ্খলা দিয়ে তৈরি জাতির গর্বিত প্রতিষ্ঠান। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর গৌরবোজ্জল ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডত্ব রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যরা অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিশ্বশান্তি রক্ষায়ও তারা পালন করে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে একটি আধুনিক, গতিশীল ও দক্ষ পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করেছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সুশৃঙ্খল, ক্ষিপ্র ও সদা তৎপর এক আধুনিক বাহিনীতে পরিণত হয়, যা বিশ্বের যেকোন আধুনিক রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সমকক্ষ।

সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সব কর্মসূচির সার্বিক সাফল্য কামনা করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আমি বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সব সদস্যকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ফেসবুকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হিংসাত্মক বিদ্বেষমূলক ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা

বর্তমান সময়ে ‘ফেসবুক’ একটি অতি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু বিপথগামী উপজাতি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এবং তাদের দোসর কতিপয় স্বার্থান্বষী তথাকথিত অনলাইন এক্টিভিস্ট ও বুদ্ধিজীবিরা ফেসবুককে তাদের হিংসাত্মক, বিদ্বেষমূলক, ঘৃণাত্মক ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা বিরোধী অপপ্রচারণার মুখপত্র বানিয়ে ছেড়েছে। তাদের এহেন প্রচারণার কারণে ইদানিং ফেসবুককে অনেকে ‘ফেকবুক’- নামেও অভিহিত করছে।

তারা বিভিন্ন নামে বেনামে ফেসবুক আইডি, পেজ আর গ্রুপ খুলে নানান রকম মিথ্যা, বানোয়াট, আজগুবি, গাঁজাখুরি আর বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করছে। তাদের এ সমস্ত প্রচারণার বেশীরভাগই রাষ্ট্রবিরোধী।

দেশের প্রচলিত আইন-কানুন আর সংবিধানকে তোয়াক্কা না করে তারা নিজেদের মত করে নানা রকম মিথ্যাচার করে থাকে। অনেকে হয়তো বলবেন ‘বাক-স্বাধীনতা’র কথা।

কিন্তু বাক স্বাধীনতা মানে এই নয় যে, আপনি দেশের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের বিপক্ষে কথা বলবেন। বাক স্বাধীনতা মানে এই নয় যে, আপনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির পথ সুগম করে তুলবেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপাখ্যানঃ পেশাভিত্তিক চাঁদাবাজি যেন বৈধ উৎসব

মাথার মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরঘুর করছে। সেটা নিয়েই আমার আজকের লেখা। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সংগঠণগুলোর কাড়ি কাড়ি টাকার উৎস কি? নানান সময়ে এরা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম এমনকি দেশের বাইরেও বিভিন্ন স্থানে সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং, সেমিনার করে। এই সমস্ত অনুষ্ঠান করতে বহুত টাকা খরচ হয়। এই টাকাগুলো আসে কোত্থেকে?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য গত বেশ কিছুদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় সরেজমিনে ঘুরে বেড়িয়েছি। কথা বলেছি সাধারণ উপজাতি-বাংগালী সবার সাথে। বিশেষ করে রাঙামাটি জেলায় একটু বেশী ঘুরেছি। পরিচিত, স্বল্প পরিচিত সবার সাথে কথা বলে যা জেনেছি- তা সত্যিই ভয়ংকর।

বৌদ্ধ হওয়ার কারণে আমার বিশেষ কিছু সুবিধা আছে। কিন্তু বাঙালী হবার কারণে সেই সাথে কিছু অসুবিধাও রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরীহ মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক চাঁদাবাজি আর বিভিন্ন এনজিও’র কাড়ি কাড়ি টাকার বিনিয়োগই হলো এই অবৈধ টাকার উৎস।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জেনেছি যে, তিন পার্বত্য জেলায় দৈনিক গড়ে দেড় কোটি টাকা চাঁদা তুলছে উপজাতি সশস্ত্র গ্রুপগুলো। চাঁদা আদায়ে নিয়োজিত রয়েছে জেএসএস ও ইউপিডিএফের পাঁচ হাজার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কর্মী। আদায় করা চাঁদার টাকা দিয়েই দলের নেতা-কর্মীদের বেতন-ভাতা, রেশন, অবসরকালীন ভাতা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি দেয়া হয়। এছাড়া পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো চাঁদার এ অর্থ দিয়ে দেশ-বিদেশে সরকার, সেনাবাহিনী এবং বাঙালি বিদ্বেষী প্রচারণা ও তাদের অস্ত্র ভান্ডার সমৃদ্ধ করার কাজ করে।

 

ইউপিডিএফ, জেএসএস(সন্তু লারমা), জেএসএস(সংস্কার)সহ নামি বেনামী আরও বহু উপজাতি গ্রুপ সক্রিয় এই চাঁদাবাজিতে। অনেকে হয়তো বলবেন যে, চাঁদাবাজি তো দেশের আরও অনেক জায়গায় হচ্ছে, এখানে বিশেষত্ব কী? কথা সত্য, কিন্তু পাহাড়ে চাঁদাবাজিতে চরম শঙ্কার কারণ এই জন্য যে, এই সমস্ত কোটি কোটি টাকা যাচ্ছে দুর্ভেদ্য পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কাছে যারা পার্বত্য জেলাগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন ‘জুম্মল্যান্ড’ গঠনের স্বপ্নে বিভোর।

বর্তমান চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের পিতা ত্রিদিব রায় ছিলো একজন কুখ্যাত রাজাকার। তার অনুসারীরা এখনো সেই আদর্শ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আর সুযোগ সন্ধানী সন্তু লারমার সাহস কোন স্তরে থাকলে ভাবুন তো, আজো সে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেনি!!!

নিজস্ব পতাকা, মানচিত্র, মুদ্রা, আইডি কার্ড থেকে শুরু করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার জন্য যত কিছু প্রয়োজন সব কিছুর প্রাথমিক যোগান তারা করে রেখেছে। এই দেশে বহু লোক নিজেকে বিরাট বড় দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচয় দেয় কিন্তু আজো কোন দেশপ্রেমিক দেশকে ভালোবেসে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছে বলে শুনিনি।

 

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক খাগড়াছড়ির এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আঞ্চলিক দলগুলোর চাঁদাবাজি অহরহ ঘটছে। কোনো পরিবহন মাল নিয়ে খাগড়াছড়ি ঢোকার সময় অথবা বের হওয়ার সময় চাঁদা দিতে হয়। একেক সময় তারা একেক স্থান থেকে চাঁদা তোলে। চাঁদা না দিলে গাড়ি থামিয়ে স্টাফদের মারধর করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। চাঁদা না দেয়ায় চলতি বছর বিআরটিসি ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের গাড়ি পুড়িয়ে দেয় ইউপিডিএফ নামক সশস্ত্র সংঠণের কর্মীরা’।

উপজাতি সংগঠণগুলো তাদের বিরুদ্ধে আনীত চাঁদাবাজির অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে থাকে। তারা বলে যে, তারা চাঁদাবাজি করে না। পাহাড়িদের কল্যাণে তারা কাজ করে, মানুষের সহযোগিতায় তাদের দল পরিচালিত হয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ( ইউপিডিএফ)’র সামরিক শাখার প্রধান প্রদীপন খীসা’র বাড়ি থেকে প্রায় ৮০ লাখ টাকার (৭৮ লাখ ৯৫ হাজার ৯৬৬ টাকা) পাশাপাশি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি উদ্ধার করে নিরাপত্তা বাহিনী। এই সমস্ত নথিপত্রের মধ্যে ইউপিডিএফের মাসিক আয় ব্যয়ের বিবরণী রয়েছে।

মাসিক প্রতিবেদন নামে জব্ধ হওয়া দুটি নথিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিভিন্ন খাতে ৫ লাখ ৮০ হাজার ১৫৮ লাখ টাকা ও গত বছরের মার্চ মাসে ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৬ টাকাসহ ১২ লাখ ৭৬ হাজার ৭৮৪ টাকা খরচের হিসাব পাওয়া গেছে। খরচের খাতগুলো হচ্ছে, খানাপিনা খাতে ৪৬ হাজার ৪৩৫ টাকা, সাংগঠনিক ৬৮ হাজার ১৪১ টাকা, যাতায়াত ও যোগাযোগ ৪০ হাজার ৫৪৫ টাকা, চিকিৎসা ৩৩ হাজার ৫২ টাকা, পরিবার ভাতা ২৭ হাজার ২৮০ টাকা, কর্মী ভাতা ১০ হাজার ৫০০ টাকা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জন্য খরচ ১৯ হাজার ৫০ টাকা, যুব ফোরামের খরচ ১৭ হাজার ৩০০ টাকা,  মোবাইল রিচার্জ ১০ হাজার ৫৫৭ টাকা, ছুটি ভাতা ৬ হাজার টাকা, পেপার বিল ২৪০ টাকা, দাপ্তরিক ৫ হাজার ৫০৬ টাকা, পোষাক পরিচ্ছদ খাতে ৮ হাজার ৯০ টাকা, নিরাপত্তা খাতে ২ হাজার ৫৭০ টাকা, হাওলাত প্রদান ১০ হাজার টাকা, হাল নাগাদ পরিশোধ ৬০ হাজার টাকা, এইচ পি বাজেট ১০ হাজার টাকা ও মেসি বাজেট ১ লাখ টাকা ইত্যাদি।

 

এতকিছুর পরও ইউপিডিএফ এই অর্থকে সংগঠনের সেবা খাতে উত্তোলিত গণচাঁদা দাবী করেছে। আমার প্রশ্ন হল এই গণচাঁদা তারা কার কাছ থেকে আদায় করেছে? চাঁদা আদায়ের অনুমতিই বা কে দিয়েছে তাদের?

তিন পার্বত্য জেলায় উপজাতি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর চাঁদা আদায়ের পরিমাণ দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়বে। পার্বত্যাঞ্চল ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাঁদাবাজি এখানে একটি স্বীকৃত বিষয়। সরকারি ভ্যাট-ট্যাক্স না দিলেও বাধ্যতামূলকভাবে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নির্ধারিত চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। থানা ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও কোনো প্রতিকার পান না ভুক্তভোগীরা।

এ প্রসংগে বান্দরবানের লামা উপজেলার এক উপজাতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে হতাশার সুরে বলেন যে, ‘শান্তি চুক্তি আমাদের জন্য হিতে-বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, শান্তি চুক্তির আগে শুধু মাত্র শান্তি বাহিনীকে চাঁদা দিতে হত আর এখন তিনটি দলকে (জেএসএস সন্তু, জেএসএস সংস্কার ও ইউপিডিএফ) চাঁদা দিতে হচ্ছে। এভাবে চাঁদা দিতে দিতে আমাদের মত স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে পেট চালানোয় দায় হয়ে পড়ছে’।

ঐ উপজাতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কথা যে মিথ্যা নয় তার প্রমাণ পেলাম বান্দরবানের জেলা প্রশাসকের এক বিবৃতিতে। গত বছর বান্দরবান জেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক পার্বত্যাঞ্চলের আঞ্চলিক তিন সংগঠন সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির চিত্র প্রকাশ্যে তুলে ধরেন।

চাকমা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা

চাকমা তথা চাংমা বাংলাদেশের প্রধান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতে চাকমাদের সংখ্যা প্রায় ৭ লক্ষ। রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলাতে এদের সংখ্যা বেশী। তবে বান্দরবানেও স্বল্প সংখ্যায় চাকমাদের উপস্থিতি রয়েছে। চাকমা জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্বাংশে তথা ত্রিপুরা ও অরুণাচল রাজ্যে বসবাস করছে। এছাড়া চাকমাদের বড় একটি অংশ অভিবাসন নিয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে।

চাকমাদের প্রধান জীবিকা কৃষি কাজ। এরা প্রধানত থেরাবাদ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তবে বর্তমানে অনেকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা নিচ্ছে। বুদ্ধপুর্ণিমা ছাড়া তাদের অন্যতম প্রধান আনন্দ উৎসব বিজু। চাকমাদের ভাষার নামও চাকমা (চাংমা)। চাকমাদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। বাঁশের অঙ্কুর হল চাকমাদের ঐতিহ্যগত খাদ্য। তারা এটাকে “বাচ্ছুরি” নামে ডাকে। এছাড়া চাকমারা শুকরের মাংস খেতে পছন্দ করে।

চাকমা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ তাদের সার্কেলের প্রধানকে রাজা বলে থাকে। সার্কেল চিফ তাদের প্রথা, রীতি, নীতি, ভূমি, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, পার্বত্য জেলা পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেয়া, কার্বারী নিয়োগ, হেডম্যান নিয়োগের মত কাজ করে থাকে। কার্বারীরা যাবতীয় ঝগড়া, নানা সমস্যার নিস্পত্তি করে থাকে। হেডম্যানরা অনেক কাজ করলেও মুল কাজ খাজনা তোলা। চাকমা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। চাকমা সমাজে ছেলেরা পূর্ব পুরুষদের সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকার। ছেলেদের বর্তমানে কন্যা সন্তান কেবলমাত্র বিয়ের কাল পর্যন্ত ভরনপোষণ পাওয়ার অধিকার রাখে। পিতা বা স্বামীর অবর্তমানে চাকমা নারীরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন।

চাকমাদের আদিনিবাস ও মূল উৎসস্থান:

চাকমাদের বিষয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে একটা আলাদা ইতিহাসগ্রন্থ হয়ে দাঁড়াবে। তবে অতি সংক্ষেপে এদের বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক।  ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, চাকমারা এই দেশের আদিবাসী নয়, তারা মঙ্গোলীয় জাতির একটি শাখা। বর্তমান মিয়ানমারের আরাকানে বসবাসকারী ডাইংনেট জাতিগোষ্ঠীকে চাকমাদের একটি শাখা হিসেবে গণ্য করা হয়।

আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে পর্তুগিজ মানচিত্র প্রণেতা লাভানহা অঙ্কিত বাংলার সর্বাপেক্ষা পুরাতন মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব চাকমাদের সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। কর্ণফুলি নদীর তীর বরাবর চাকমাদের বসতি ছিল। চাকমাদের আরও আগের ইতিহাস সম্পর্কে দুটি তাত্ত্বিক অভিমত প্রচলিত। উভয় অভিমতে মনে করা হয়, চাকমারা বাইরে থেকে এসে তাদের বর্তমান আবাসভূমিতে বসতি স্থাপন করে। বিশেষজ্ঞের অভিমত অনুযায়ী, চাকমারা মূলত ছিল মধ্য মায়ানমার ও আরাকান এলাকার অধিবাসী।

এ অভিমতে বলা হয়, চাকমারা উত্তর ভারতের চম্পকনগর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অভিবাসী হিসেবে আসে। আঠারো শতকের শেষের দিকে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলই নয় বরং আজকের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার পাহাড়ি এলাকাগুলোতেও তাদের বিক্ষিপ্ত অবস্থান ছিল।

রাজা ভুবনমোহন রায় বিরচিত এবং বিপ্রদাশ বড়ুয়া সম্পাদিত ‘চাকমা রাজবংশের ইতিহাস’ নামক বইয়ে উল্লেখ করা আছে যে, চাকমা ও বড়ুয়ারা দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম ও আরাকানে বাস করলেও তাঁরা এখানকার আদি বাসিন্দা নন জানতে পারি। চাকমারা চম্পকনগর থেকে এসেছেন- সেই হারানো চম্পকনগরের সংখ্যা এক নয়, একাধিক- তাও জানতে পারি’।

বৃটিশ কর্ণেল প্রী (Colonel Phyree) চট্টগ্রামের বড়ুয়া ও চাকমাদের ব্রহ্ম ইতিহাসের ৪৭ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে, বড়ুয়া ও চাকমাদের আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যতার জন্য তাঁহারা দক্ষিণ বিহার অর্থাৎ মগধ হইতে আসিয়া থাকিবেন’।

 

আসামের ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তীতে চাকমা রাজ্যের রাজধানী ছিল চম্পক নগর। অনেকে বিশ্বাস করে চম্পকনগর ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এবং চাকমারা চন্দ্র বংশের ক্ষত্রীয়দের উত্তরসূরী কিন্তু তাদের চেহারার বা মুখমন্ডলের বৈশিষ্ট্য আর্যদের চেয়ে মঙ্গোলীয়দের সঙ্গে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। সিংহভাগ চাকমাদের বিশ্বাস, তারা উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের পরবর্তী বংশধর।

সার্বিক বিবেচনায় তাই বলা যায় যে, চাকমা বা অন্যান্য উপজাতীয়রা নয়, বরং বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষীরাই এই দেশের আদিবাসী। কারণ তারাই প্রোটো-অস্ট্রোলয়েড (Proto Astroloid) নামের আদি জনধারার অংশ এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তারাই একমাত্র আদিবাসী বা Son of the Soil বলে দাবি করতে পারে। এর পেছনে অনেক জাতিতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণও রয়েছে। বিশ্বের তাবৎ শীর্ষস্থানীয় নৃবিজ্ঞানী এবং গবেষকবৃন্দই এ ব্যাপারে একমত।

আদিবাসী বিতর্ক এবং চাকমাদের অবস্থান:

 

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই; বরং মূল বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিপরীতে এই অ-বাঙালি জনসমষ্টিকে- উপজাতি; ক্ষুদ্র জাতিসত্তা; নৃগোষ্ঠী নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু, এই অ-বাঙালি জনগোষ্ঠী জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণা ২০০৭ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১০৭ ও ১৬৯ নং কনভেনশনের ঘোষণা অনুযায়ী নিজেদের আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি আদায়ের কর্মসূচি পালন করে আসছে।

তবে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থানের ফলে আদিবাসী ইস্যু কিছুটা স্তিমিত হলেও কতিপয় চাকমা নেতা দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের হাত করে এ ব্যাপারে তাদের অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বিশেষতঃ UNPFII (United Nations Permanent Forum on Indigenous Issues), ILO (International Labour Organization), CHTC (Chittagong Hill Tracts Commision), আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস, আদিবাসী ফোরাম ইত্যাদি সংগঠনের মদদে এই ইস্যুটি এখনও চলমান রয়েছে। এতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় এবং অন্যান্য চাকমা শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একাংশ।

চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায় UNPFII’এর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে ২০১১-২০১৩ এবং ২০১৪-২০১৬ সালের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই অবস্থানকে পুঁজি করে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী/সংস্থাসমূহের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে অত্যন্ত সুকৌশলে ইস্যুটির স্বপক্ষে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া, বিভিন্ন দেশে (অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, থাইল্যান্ড, ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ইত্যাদি) অভিবাসী হিসেবে বসবাসরত পার্বত্য উপজাতীয় সদস্যদের দ্বারাও একই তৎপরতা লক্ষ করা যায়।

সেই সাথে দেশের অভ্যন্তরে সরকারি বিভিন্ন পদস্থ কর্মকর্তা বা সংস্থার ব্যানারে এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধির মাধ্যমে এই দাবির পক্ষে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে অত্যন্ত সুকৌশলে একচেটিয়া প্রচারণা চালানো হয়, যা সরকারের ভাবমর্যাদা ও অবস্থানকে ক্ষুণ্ন করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে, মানবাধিকার কমিশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন’কে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে এবং কতিপয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দ্বারা আদিবাসী প্রচারণায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই দাবিকে পুনরায় জোরালো করবার তৎপরতা জারি রয়েছে।

চাকমাদের আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়?

আমার মত অনেক মানুষের মাথার মধ্যেই এই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশের ভেতর সকল উপজাতীয়রা স্বায়ত্তশাসিত বা স্বশাসিত অঞ্চল ও সরকার ব্যবস্থার বৈধতা পাবে। ফলে বাংলাদেশকে বিভক্ত করে তাঁরা নতুন রাষ্ট্র গঠনের বৈধতা পাবে। এসব অঞ্চলে সরকার পরিচালনায় তারা নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামো, জাতীয়তা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, আইনপ্রণয়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে এবং এসব অঞ্চলের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অধিকার ও কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন হবে। এ জন্যই চাকমারা পার্বত্য জেলাগুলোকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন ‘জুম্মল্যান্ড’ গঠনের স্বপ্নে বিভোর।

বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের পিতা ত্রিদিব রায় ছিলো একজন কুখ্যাত রাজাকার। তার অনুসারীরা এখনো সেই আদর্শ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আর সুযোগ সন্ধানী সন্তু লারমার সাহস কোন স্তরে থাকলে ভাবুন তো, আজো সে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেনি!!! নিজস্ব পতাকা, মানচিত্র, মুদ্রা, আইডি কার্ড থেকে শুরু করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার জন্য যত কিছু প্রয়োজন সব কিছুর প্রাথমিক যোগান তারা করে রেখেছে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে সিএইচটি জুম্মল্যান্ড নামে চাকমা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরিচালিত একটি পেইজের ঠিকানা এখানে দেয়া হলো (https://web.facebook.com/JUMMALAND.BD/?hc_ref=ARS8eWssT9AHidH9N357RcPPQu-q-evCgsma1Qx8_kwoIZD1hdsvT3vn7Bjh6VPwpnM)।

শুধু ফেসবুক বা সামাজিক গণমাধ্যম নয়, পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল খুলেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনের প্রচার চালাচ্ছে। তারা দাবি করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন করার মতো পর্যাপ্ত অস্ত্র তাদের হাতে রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের উপজাতিদের আদিবাসী স্বীকৃতি কোনো ছেলের হাতের মোয়া নয়। এর সাথে জড়িত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, অস্তিত্ব, কর্তৃত্ব, ইতিহাস ও মর্যাদার প্রশ্ন।

 

মুক্তিযুদ্ধ ও চাকমাদের বিতর্কিত অবস্থান:

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কতিপয় উপজাতীয় লোকজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকলেও বেশিরভাগ উপজাতীয়রা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে। বর্তমান চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের পিতা ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন। তার আশঙ্কা ছিল যে স্বাধীন বাংলাদেশে চাকমা রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন থাকবে না এবং বাঙালিদের কারণে চাকমারা স্থানচ্যুত হবে। তাই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত থেকে স্বায়ত্ত্বশাসন বজায় রাখতে চেয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি রাংগামাটি জেলার রিজার্ভ বাজার এবং তবলছড়ি বাজারে জনসভায় ভাষণ দেন। এসব জনসভায় তিনি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। ত্রিদিব রায় বাংলাদেশের একমাত্র যুদ্ধপরাধী যার লাশ পাকিস্তানে সমাহিত করা হয়েছে। যদিও তার ইচ্ছা ছিল যাতে তার শেষকৃত্য বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে তা সম্ভব হয়নি। মৃত্যুর দশদিন পর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে তাকে দাহ করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করতে এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডে চাকমা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভূমিকা:

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীল পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা স্বাধীন ‘জুম্মল্যান্ড’ নামক দেশ গঠনের জন্য চাকমা নেতাদের একাংশ গোপনে বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে। তারা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন উগ্রপন্থী সংগঠনসহ নানান সংস্থার সাথে এ ব্যাপারে লবিং করছে। পাশাপাশি তারা নিজেদের সশস্ত্র সংগঠনের জন্য ব্যাপক অস্ত্র ক্রয় করছে। জানা যায় যে, পার্বত্য চট্রগ্রামের উপজাতি সন্ত্রাসীদের কাছে মায়ানমার থেকে সব অস্ত্রের চালান আসতো আরাকান আর্মির নেতা ডা. রেনিন সোয়ের মাধ্যমে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান তিনটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস(সন্তু), জেএসএস(সংস্কার) এবং ইউপিডিএফ এবং এর সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মূল চালিকা শক্তি এই চাকমা উপজাতির একাংশ। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এম এন লারমার সশস্ত্র গেরিলা শান্তিবাহিনী গঠন; সন্তু লারমা, দেবাশীষ রায়, ঊষাতন তালুকদারদের দেশীয় স্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন প্রচারণার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের সহায়তায় নতুন উদ্ভাবিত “আদিবাসী” স্বীকৃতির দাবী, ‘জুম্মল্যান্ড’ নামে আলাদা দেশ গঠনের চক্রান্ত এসব কিছুই চাকমা সম্প্রদায়ের দেশদ্রোহিতার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে ফুটে ওঠে।

 

চাকমাদের একক আধিপত্যের কারণে পিছিয়ে পড়ছে অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়:

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের বসবাস থাকলেও সর্বক্ষেত্রেই চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গই নেতৃত্বের শীর্ষ স্থান দখল করে আছে। শিক্ষা এবং চাকুরীর ক্ষেত্রে চাকমারা অন্যান্য উপজাতিদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। ২০১১ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে সামগ্রিক শিক্ষার হার ৫৯.৬২% যেখানে চাকমাদের শিক্ষার হার ৭৩%। অথচ, পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য সকল উপজাতিদের শিক্ষার হার ৪৪.৬২%।

শান্তিচুক্তির পর গড়ে ওঠা সংস্থাসমুহ যেমন- আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ ইত্যাদিতে চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ অধিকাংশ সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। বাংলাদেশ সরকার ৫% উপজাতি কোটা বরাদ্দ করলেও এর অধিকাংশই চাকমারা ভোগ করছে। একই সাথে, বিদেশী সংস্থাসমূহের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ দায়িত্বপ্রাপ্ত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ এবং চাকমা সম্প্রদায়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চাকমা নেতৃত্বের মধ্যে একপ্রকার স্বার্থপরতা, ক্ষমতার প্রতি লোভ এবং যেকোন প্রকারে শীর্ষ স্থান দখলের প্রবণতা কাজ করেছে।

চাকমাদের এই স্বার্থপরতা এবং ক্ষমতার লোভের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায় অনগ্রসরতার বেড়াজাল থেকে বের হতে পারছে না। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে চাকমারা নিজেদের স্বার্থের কারণে কুক্ষিগত করে রেখেছে। চাকমা সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সবসময় ‘নিজ’ এবং গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে দেখা গিয়েছে। চাকমাদের এই একক আধিপত্য ও স্বার্থপরতাকে অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায় মেনে নিতে পারে না কিন্তু চাকমাদের সশস্ত্র সংগঠন আর বিভিন্ন দেশী-বিদেশী মহলে যোগাযোগ থাকার কারণে তারা ভয়ে কিছু বলতে পারে না।

পরিশেষ:

চাকমা সম্প্রদায়ের চিহ্নিত কিছু নেতৃবৃন্দ যদি স্বার্থপরতা ভুলে নিজ দেশ বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে তবে তা পার্বত্য চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া অন্যান্য সম্প্রদায়কে আরো উন্নত গর্বিত বাংলাদেশী নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের এই বাংলাদেশ। সকল সম্প্রদায়ের কৃষ্টি-কালচার মিলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ। আর তাই অতীতের সংঘাত এবং জাতিগত ভেদাভেদ ভুলে সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে এ দেশ সোনার বাংলা হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই।

যুগে যুগে চাকমা নেতৃত্বে স্বার্থপরতা এবং অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম

১৯৯৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপজাতি নেতৃত্বের সাথে যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল তার ফলস্বরূপ এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা কাঙ্ক্ষিত ছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়নের করেছে এবং অবশিষ্ট ধারাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু ভূমিবণ্টনসহ অন্যান্য কিছু মৌলিক বিষয়ে বিভিন্ন দল ও জনগোষ্ঠীর মতামতে ভিন্নতা শান্তিচুক্তির অবাস্তবায়িত ধারাসমূহ বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি করেছে।

ইতোমধ্যে পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি আঞ্চলিক নেতৃত্বের মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তির কারণেও চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী পিসিজেএসএস ছাড়াও অন্য আরও দুইটি আঞ্চলিক উপজাতি দল গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে একটি দল ইউপিডিএফ শান্তিচুক্তির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে স্বায়ত্বশাসন দাবি করছে। অন্যদিকে আঞ্চলিক অপর দল জেএসএস (সংস্কার), জেএসএস (মূল) দলের সাথে নেতৃত্বের সংঘাতে জড়িয়ে পৃথক অবস্থানে রয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাঙ্ক্ষিত শান্তি ফিরে আসার কথা থাকলেও সেই অনুযায়ী আশানুরূপ শান্তি ফিরে আসেনি। আঞ্চলিক উপজাতি তিনটি দলই পৃথক পৃথক সশস্ত্র গ্রুপ পরিচালনা করে।

তিনটি দলই সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে নিয়মিত চাঁদাবাজী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আঞ্চলিক উপজাতি দলসমূহের সশস্ত্র সংগঠনসমূহ আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ উপজাতি-বাঙালি অধিবাসীগণ উল্লেখিত তিনটি সশস্ত্র সংগঠনের চাঁদাবাজীতে অতীষ্ঠ। সশস্ত্র সংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্যের কারণে পার্বত্য অঞ্চলে গড়ে উঠছে না কোন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিমূলক স্থাপনা।

অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনুমান করা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমানে এই অশান্ত হয়ে ওঠা, শান্তিচুক্তির পরেও সাধারণ উপজাতি, বাঙালিদের নিরাপত্তাহীনতা এসব কিছুর জন্যই কিছু কিছু উপজাতি নেতৃবৃন্দের স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিগত ক্ষমতা গ্রহণের লিপ্সাই দায়ী।

ঐতিহাসিকভাবে এবং বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আঞ্চলিক উপজাতি দলসমূহের নেতৃত্বে সব সময় চাকমা সম্প্রদায়ই সুদৃঢ় অবস্থানে ছিল এবং বর্তমানেও আছে। বর্তমানে অশান্ত এই পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি আঞ্চলিক দল এবং এর সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে মূলত চাকমারাই আছে।

একই সাথে আরও একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, শান্তিচুক্তির ফলে গড়ে ওঠা সংস্থাসমূহ যেমন- আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ ইত্যাদিতে চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। একই সাথে বিদেশি সংস্থাসমূহের শীর্ষস্থানীয় পদসমূহে চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ দায়িত্ব প্রাপ্ত রয়েছে।

তাই সার্বিকভাবে বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রধানত ১৩ থেকে ১৪টি উপজাতি সম্প্রদায়ের বসবাস থাকলেও সর্বক্ষেত্রেই চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গই নেতৃত্বের অবস্থানে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চাকমা সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব কতটুকু সাধারণ উপজাতিদের কল্যাণে কাজ করছে এবং চাকমা ব্যতিত অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়ের অধিবাসীবৃন্দই বা কতটুকু উপকৃত হচ্ছে।

পার্বত্য অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহ এবং চাকমা সম্প্রদায়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চাকমা নেতৃত্বের মধ্যে এক প্রকার স্বার্থপরতা, ক্ষমতার প্রতি লোভ এবং যেকোন প্রকারে শীর্ষস্থান দখলের প্রবণতা কাজ করেছে। চাকমা সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সবসময় ‚নিজ এবং ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে দেখা গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সম্প্রদায়ের জমিদারদের মধ্যে স্বীকৃত প্রথম জমিদার কালিন্দি রায়ের সিপাহী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ, ইংরেজদের তুষ্ট করার প্রবণতা, ইংরেজ কর্তৃক দেশ বিভাগের সময় সকল উপজাতি সম্প্রদায়ের ভারতের সাথে সংযুক্তির ইচ্ছে থাকলেও নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য নলিনাক্ষ রায়ের পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তিতে স্বস্তি, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ত্রিদিব রায়ের পাকিস্তানকে সমর্থন ও সহযোগিতা, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এম এন লারমা কর্তৃক সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন শান্তিবাহিনী গঠন, দেবাশীষ রায়ের দেশবিরোধী প্রচারণার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্বার্থন্বেষী মহলের সহায়তায় নতুন উদ্ভাবিত ‘আদিবাসী’ দাবি ইত্যাদি, এসব কিছুই চাকমা সম্প্রদায়ের কোন কোন গোত্রের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের স্বার্থপরতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফুটে ওঠে।

সার্বিক বিষয়ে আলোচনার পূর্বে আসুন চাকমা জাতির ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেয়া যাক। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, চাকমারা মঙ্গলীয় জাতির একটি শাখা, বর্তমান মায়ানমারের আরাকানে বসবাসকারী ডাইংনেট জাতি গোষ্ঠীকে চাকমাদের একটি শাখা হিসেবে গণ্য করা হয়। চাকমারা প্রধানত থেরাবাদ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী, চাকমাদের ভাষার নাম চাকমা (চাংমা)। চাকমারা ৪৬টি বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। পূর্বে এ জাতি হরি ধর্মের অনুসারী হলেও পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। চাকমা শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘শক্তিমান’ থেকে আগত। বর্মী রাজত্বের শুরুর দিকে বর্মী রাজারা ‘চাকমা’ শব্দটি প্রচলন করেন।

তখনকার সময় বর্মী রাজারা চাকমাদের রাজার পরামর্শক, মন্ত্রী এবং পালি ভাষার বৌদ্ধ ধর্মের পাঠ অনুবাদকের কাজে নিয়োগ করতেন। রাজা কর্তৃক সরাসরি নিয়োগকৃত হওয়ায় বর্মী রাজ পরিবারে চাকমারা বেশ প্রভাবশালী ছিলো। তবে চাকমাদের চতুরতা ও স্বার্থপরতা বর্মীদের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। বার্মায় প্রচলিত চাকমাদের নাম সংক্ষেপ ‘সাক’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘শক্তিমানের’ বিকৃত রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরবর্তীতে এই জনগোষ্ঠীর নাম ‘সাকমা’ এবং কালক্রমে ‘চাকমা’ নামেই পরিচিতি লাভ করে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, চাকমা সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে ঐতিহাসিকভাবেই বিভিন্ন মহলের নেতিবাচক অনুভূতি ছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ চাকমাই আরাকান অঞ্চল থেকে শরণার্থী হিসেবে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে এসেছিল। চাকমাদের তথাকথিত রাজবংশের শুরুটা ছিল কালিন্দি রায়ের মৃত্যুর পর থেকে। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কালিন্দি রায় ও ধরম বক্স খাঁ’র কন্যা মেনকা এবং তার স্বামী গোপীনাথ দেওয়ান চাকমার সন্তান হরিশ্চন্দ্র রায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের জমিদারির দায়িত্ব পাবার পর, ‘এই অঞ্চলটি চাকমাদের’ এরূপভাবে প্রচার পেতে শুরু করে।

মোঘল জমিদার ধরম বক্স খাঁর মৃত্যুর পর তার প্রথম স্ত্রী কালিন্দি রায় (যিনি চাকমা সম্প্রদায় থেকে জমিদার পরিবারের বধূ হয়ে এসেছিলেন) ব্রিটিশদের আনুকূল্যে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা লাভের পূর্বে চাকমাদের জন্য পৃথক কোন জমিদারি ছিল না। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে চাকমা সম্প্রদায় আরাকানিদের নিকট থেকে বিতাড়িত হবার পর প্রাথমিক পর্যায়ে বান্দরবানের আলীকদমে অবস্থান নেয়, তবে চাকমাদের পূর্বে আলীকদমে মোঘলদেরও অবস্থান ছিল। বিভিন্ন সময় উত্থান পতনের পর আলীকদম থেকে মোঘল জনগোষ্ঠীর জমিদারগণ ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় অবস্থান নেন।

আর এখানে প্রথম জামিদারি স্থাপন করেন শেরমস্ত খাঁ (১৭৩৭-১৭৫৩ খ্রি.)। এরপর যথাক্রমে রাজা শুকদেব (১৭৫৩-১৭৫৮ খ্রি.), রাজা শের জব্বার খাঁ (১৭৫৮-১৭৬৫ খ্রি.), রাজা শের দৌলত খাঁ (১৭৬৫-১৭৮২ খ্রি.), রাজা জানবক্স খাঁ (১৭৮২-১৮০০ খ্রি.), রাজা তব্বার খাঁ (১৮০০-১৮০১ খ্রি.), রাজা জব্বর খাঁ (১৮০১-১৮১২ খ্রি.), রাজা ধরম বক্স খাঁ (১৮১২-১৮৩২ খ্রি.) এবং কালিন্দি রায় (১৮৪৪-১৮৭৩ খ্রি.) পর্যায়ক্রমে জমিদারি পরিচালনা করেন। কিন্তু এই জমিদার পরিবারের বিপত্তি শুরু হয় ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে যখন রাজা জব্বর খাঁ তার উত্তরাধিকার হিসেবে কোন পুত্র না থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। রাজা জব্বর খাঁর মৃত্যুর ১৮ মাস পর তার স্ত্রীর গর্ভে পুত্র সন্তানের (ধরম বক্স খাঁ) জম্ম হলে ঐ সন্তানকে জমিদারের উত্তরাধিকারী হিসেবে কেউ মেনে নিতে চায়নি। ব্রিটিশরা এই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে।

তারা জমিদার পরিবারের বিশৃংখল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মুসলিম এবং মোঘলদের কোণঠাসা করতেই বিতর্কিত শিশু ধরম বক্স খাঁ’র পক্ষ নেয় এবং তাদের সহযোগিতায় ধরম বক্স খাঁ জমিদার হিসেবে ঐ সময় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে মাত্র বিশ বছর বয়সে রোগাক্রান্ত হয়ে রাজা ধরম বক্স খাঁ মৃত্যুবরণ করায় আদালতের রায়ের মাধ্যমে ইংরেজ সরকার মোঘল বংশাজাত সুখলাল খাঁকে জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে। কিন্তু ধরম বক্স খাঁ’র স্ত্রী কালিন্দি রায় (চাকমা সম্প্রদায়ের মেয়ে, ধরম বক্স খাঁ’র স্ত্রী) বিষয়টি আদালতে আপিল করলে দীর্ঘ ১২ বছর পর ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে তার অনুকূলে রায় পান। তারপর থেকে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালিন্দি রায় জমিদারী পরিচালনা করে মৃত্যুবরণ করেন। কালিন্দি রায়ের মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র হরিশ্চন্দ্র জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমান চাকমা সম্প্রদায়ের তথাকথিত রাজাদের রাজত্ব হরিশ্চন্দ্র থেকেই শুরু হয়েছিল।

এখানে আরো একটি বিয়য় বলে রাখা ভালো। ১৮৫৭ সালে হরিশ্চন্দ্র তৎকালীন জমিদার কালিন্দির নির্দেশে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকারকে সহায়তা করার উপহার স্বরূপ রায়বাহাদুর খেতাব অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীতে হরিশ্চন্দ্র জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণের পর রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর থেকে তার জমিদারী রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তর করেন। রাঙ্গামাটিতে চাকমাদের জমিদারি স্থানান্তরের পর যথাক্রমে হরিশ্চন্দ্র রায় (১৮৭৩-১৮৮৫ খ্রি.), ভুবন মোহন রায় (১৮৮৬-১৯৩৩ খ্রি.), রাজা নলিনাক্ষ রায় (১৯৩৪-১৯৫১ খ্রি.), রাজা ত্রিদিব রায় (১৯৫২-১৯৭১ খ্রি.), রাজা কুমার সুমিত রায় (১৯৭২-১৯৭৭ খ্রি.) এবং রাজা দেবাশীষ রায় (১৯৭৭ থেকে বর্তমান পর্যন্ত) চাকমা সম্প্রদায়ের রাজা হিসাবে কর্তব্য পালন করছেন। এখানে উল্লেখ্য, চাকমা সম্প্রদায়ের জমিদারদেররায় ‘বাহাদুর’ উপাধি থাকলেও তারা ‘রাজা’ ছিল না।

১৯৩৯ সালের ৮ জুন ইংরেজ সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের জন্মদিবস উপলক্ষে সম্রাট জয়ন্তীতে তৎকালীন চাকমা জমিদার নলিনাক্ষ রায়কে ‘রাজা’ উপাধি প্রদান করা হয়। তার পর থেকে নলিনাক্ষ রায় নিজে এবং তার উত্তরাধিকারীগণ তাদের নামের শুরুতে ‘রাজা’ উপাধি ব্যবহার করছেন। ইংরেজ শাসনামলে ভারতবর্ষে মুসলমানদের দূরবস্থার সাথে সাথে প্রভাবশালী হিন্দুদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। চাকমা সম্প্রদায়ের মেয়ে বিচক্ষণ জমিদার কালিন্দি রায়ও এটা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন বিধায় তিনি ইংরেজদের সহায়তায় জমিদারির দখল রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিনিময়ে তিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক সিপাহীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাদের গ্রেফতার করে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেন।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ ওয়াজিউল্লাহ তার ‘আমাদের মুক্তি-সংগ্রাম’, ১৯৬৭, পৃ.-১০৩-এ লিখেছেন, ‘কালিন্দির পূর্বে প্রত্যক্ষভাবে চাকমাদের সাথে ব্রিটিশ কোম্পানির তেমন কোন বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। বিচক্ষণ কালিন্দি রায় আনুগত্য লাভের আশায় ব্রিটিশ সরকারকে বিশেষভাবে সহযোগিতা প্রদান করেন। এমনকি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে সিপাহী বিদ্রোহকালে বিদ্রোহী সৈনিকরা পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করলে, কালিন্দি রায় তাদেরকে ধৃত করার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে সহযোগিতা করেছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের পলাতক সৈনিকদের বিরুদ্ধে এহেন দায়িত্ব পালনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে কালিন্দি রায়কে কর্ণফুলী নদীর বার্ষিক জলকর (১১৪৩ টাকা) মওকুফ করে দেয়।’ অর্থাৎ কালিন্দি রায়ের হাত ধরে যে চাকমা রাজত্বের ইতিহাস শুরু সেই ইতিহাসে রয়েছে কালিন্দির স্বামী ধরম বক্সের বিতর্কিত পিতৃ পরিচয় এবং পরবর্তীতে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সিপাহী বিদ্রোহে স্বাধীনতাকামীদের সাথে বেঈমানির ইতিহাস।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর রাঙ্গামাটিতে চাকমাদের অন্য একজন রাজনৈতিক নেতা স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে ধর্মের ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারিত হচ্ছে এই হিসেবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের সাথে যুক্ত হবে এই আশায় ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেন, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিশেষ আলোচিত অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। যদিও তৎকালীন ইংরেজ জেলা প্রশাসক কর্নেল জি. এল. হাইড নিজেও উক্ত পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পতাকায় স্যালুট করেন তথাপি বাউন্ডারি কমিশনের প্রধান স্যার সিরিল রেডক্লিফ এর নেতৃত্বাধীন পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন অর্থনৈতিক এবং অবস্থানগত কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও এলাকাটি পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্তটি অনেককে অবাক করলেও, তৎকালীন চাকমা রাজা নালিনাক্ষ রায় খুশিই হয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, ভারতের কংগ্রেস নীতি অনুযায়ী তারা স্বাধীন ভারতে কোন ধরনের স্থানীয় রাজা-রাজ কুমার বা রাজকীয় ক্ষুদ্র রাজ্য মেনে নেবে না। চাকমা রাজার পক্ষে ভারতে যোগ দিয়ে রাজত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হতো।

রাজা নলিনাক্ষের মৃত্যুর পর তার পুত্র ত্রিদিব রায় যখন ১৯৫১ সালে রাজা হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তিনি পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করা শুরু করেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য অর্থাৎ এমপি। কাপ্তাই হাইড্রো প্রজেক্টের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের সাথে প্রথম দিকে মতবিরোধ থাকলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রলোভনে তিনি সর্বতোভাবে সহযোগিতা করা শুরু করেন। রাজা ত্রিদিব রায় মনে করেছিলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসনই পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করবে।

তাই পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক এবং বেসামরিক আমলাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। লন্ডনভিত্তিক ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রিয়জিত দেব সরকার রচিত তার বই ‘দ্য লাস্ট রাজা অর ওয়েষ্ট পাকিস্তান’ বইটির তথ্য অনুযায়ী, ত্রিদিব রায়ের সিদ্ধান্ত ছিল আত্মস্বার্থ কেন্দ্রিক। নিজের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতেই ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের সাথে হাত মিলিয়েছেন। উনি চাইছিলেন তার রাজত্ব এবং রাজ পরিবারের শাসন যেন বজায় থাকে। যদিও অনেক সাধারণ চাকমা তার নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া না দিয়ে ত্রিদিব রায় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে না দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেন। চাকমা রাজা হিসেবে তার প্রভাবাধীন হেডম্যান-কারবারীদের ব্যবহার করে চাকমা যুবকদের দলে দলে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করেন। তাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিয়ে লেলিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তানের পরাজয় অনুধাবন করতে পেরে ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায় মিয়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান।

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বের হওয়া হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র’ (সশস্ত্র সংগ্রাম-১) নবম খণ্ডের (জুন, ২০০৯) ৯৩ পৃষ্ঠায় মে.জে. মীর শওকত আলী (বীর উত্তম) লিখেছেন, ‘চাকমা উপজাতিদের হয়ত আমরা সাহায্য পেতাম। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরোধিতার জন্য তারা আমাদের বিপক্ষে চলে যায়।’

অন্যদিকে ১৯৭১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) এইচটি ইমাম তার বই ‘বাংলাদেশ সরকার-১৯৭১’-এর (মার্চ, ২০০৪) ২৬০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় প্রথম থেকেই নির্লিপ্ত এবং গোপনে পাকিস্তানীদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন।’ বাংলাদেশ এবং বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব ও কার্যক্রমের পুরস্কার স্বরূপ ‘পাকিস্তানের জাতীয় বীর’ খেতাব এবং আজীবন মন্ত্রিত্ব নিয়ে তিনি পাকিস্তানেই বসবাস করেছেন।

অপরদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের রেখে যাওয়া রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) গড়ে তোলেন সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী। গত তিন যুগের বেশি সময় ধরে অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে হাজার হাজার নিরীহ পাহাড়ি বাঙালি জনগণ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। এদেরই উত্তরসূরিদের হাতে এখনো অব্যাহতভাবে চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং খুনের শিকার হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অসহায় মানুষগুলো।

২০০৩ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনী মূলক বই The Departed Melody-তে ত্রিদিব রায় নিজেই রাজাকার হিসেবে তার কর্মকাণ্ড বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করেছেন এবং এসব অপকর্মের কারণে তিনি অনুতপ্ত তো ননই বরং গর্ব প্রকাশ করেছেন তার বইয়ে। একই সাথে তিনি মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ব্যঙ্গ করার পাশাপাশি পাকিস্তানী হানাদারদের প্রসংশা করেছেন।

১৯৭১ সালের নভেম্বরে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়তায় মায়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান সরকার তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে ঐ বছরই থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে প্রেরণ করে। জাতিসংঘের ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত জেনারেল এসেম্বলিতে বাংলাদেশের সদস্য পদ প্রদানের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে পাকিস্তান সরকার-এর বিরোধিতা করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং করার জন্য ত্রিদিব রায়কে প্রধান করে এক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ত্রিদিব রায়ের লবিংয়ের কারণে চীন ভেটো প্রয়োগ করায় ঐ বছর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করতে ব্যর্থ হয়।

তার এই সফলতায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং তার মন্ত্রিসভা জাতিসংঘ ফেরত ত্রিদিব রায়কে ‘জাতীয় বীর’ খেতাব দিয়ে লাল গালিচা সংবর্ধনা প্রদান করে। পরবর্তীতে ত্রিদিব রায় ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে, প্রবন্ধ লিখে, বই লিখে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। গত ২০০০ সালের ৪ অক্টোবর পাকিস্তানি ইংরেজী দৈনিক ডন পত্রিকায় ‘চিটাগং হিল ট্র্যাক্ট: লেট জাস্টিস বি ডান’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধ এবং ২০০৩ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ The Departed Melody-তে সরাসরি বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতাবিরোধী বক্তব্য রেখেছেন।

ত্রিদিব রায় পাকিস্তান সরকারের কাছে এতটাই অনুগত ছিলেন যে, তাকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ফেডারেল মন্ত্রী, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত পর্যটন ও সংখ্যালঘু বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকার ৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত করে আর্জেন্টিনায় প্রেরণ, ১৯৯৫ সালের মে মাস থেকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় এ্যাম্বাসেডর এ্যাট লার্জ হিসেবে নিয়োগ, ২ এপ্রিল ২০০৩ থেকে পাকিস্তানের দপ্তর বিহীন ফেডারেল মন্ত্রী হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। রাজা ত্রিদিব রায়ের উত্তরসূরি তার সন্তান তথা বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় এর ভূমিকা সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী বলে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

‘আদিবাসী’ ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিরোধী বক্তব্য এবং অব্যাহত অপপ্রচার তারই সাক্ষ্য বহন করে। চাকমা রাজপরিবারের প্রধানদের ধারাবাহিক এসব কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, তারা সব সময়ই এদেশ এবং এদেশের মুক্তিকামী মানুষের আবেগ ও প্রত্যাশার বিরোধী ছিল এবং এখনো তাদের মধ্যে এই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব বিদ্যমান রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় চাকমা রাজপরিবারের ইতিহাসকে স্বার্থপরতার ইতিহাস বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।

দেবাশীষ রায় ১৯৯৮ সালে ‘টংগ্যা’ নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৯৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে বাঙালি বিদ্বেষী ব্যক্তিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য এনজিওগুলোর সমন্বয়ে হিল ট্র্যাক্ট এনজিও ফোরাম (এইচটিএনএফ) নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। এর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি নিজেই। সংগঠনটির বাঙালি বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড এবং পাহাড়ে জাতিগত বৈষম্য তৈরিতে ভূমিকা রাখার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো কর্তৃক উক্ত এনজিওর কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরবর্তীতে এইচটিএনএফ এর আদলে প্রতিষ্ঠা করা হয় এইচটিএনএন নামের আরো একটি সংগঠন।

ব্রিটিশ আমল থেকেই সরকারগুলো ধারাবাহিকভাবে পার্বত্যাঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে বাধার সন্মুখীন হয়ে এসেছে। প্রথম দিকে ব্রিটিশরা তাদের শাসন কার্য পরিচালনার সুবিধার্থে কিছুসংখ্যক পাহাড়িকে শিক্ষিত করার উদ্যোগ নিলে চাকমা রাজপরিবার থেকে বাধা দেয়া হয়। ব্রিটিশরা ১৯৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা দান চালু করেও এই পাহাড়ি নেতাদের আন্দোলনের কারণেই তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল।

এখানে উল্লেখ্য রাঙ্গামাটি হাই স্কুলও সাধারণ পাহাড়িদের শিক্ষিত করার ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি, বরং বর্তমান চাকমা সার্কেল চীফের পূর্ব পুরুষ ভূবন মোহন রায়কে শিক্ষিত করার জন্য এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৮৯০ সালে গড়ে তোলা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে, ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাঙ্গামাটি কলেজ। কিন্তু এটি স্থাপনও সহজ কাজ ছিল না। কারণ তৎকালীন চাকমা সার্কেল চীফ ত্রিদিব রায় রাঙ্গামাটিতে কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি শুধু বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হননি বরং এটি যাতে কোনভাবেই বাস্তবায়িত হতে না পারে সে চেষ্টাও করেছিলেন। এর জন্য তিনি প্রথমে ঢাকার রাজস্ব বোর্ডের সদস্য এস এম হাসানের কাছে এবং পরবর্তীতে তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার করিম ইকবালের কাছে চিঠি লিখে রাঙ্গামাটিতে কলেজ স্থাপনের প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার সিদ্দিকুর রহমানের দৃঢ়তায় শেষ পর্যন্ত কলেজটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

চাকমা রাজপরিবার কর্তৃক সাধারণ পাহাড়িদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের পথে অন্তরায় সৃষ্টির আরো অনেক নির্মম ইতিহাস পাওয়া যাবে অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে ২০০২ সালে প্রকাশিত শরদিন্দু শেখর চাকমার আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আমার জীবন (প্রথম খন্ড)’ এর বিভিন্ন স্থানে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক রাঙ্গামাটিতে মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে চাকমা সম্প্রদায়ের নেতৃত্বাধীন উপজাতি আঞ্চলিক দলগুলোর প্রবল বাঁধার মুখে পড়ে। পরবর্তীতে সরকার উপজাতি নেতৃবৃন্দের সাথে সমন্বয় করে উক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ চালু করতে সমর্থ হয়।

সার্বিক বিষয় বিশ্লেষনে নিঃসন্দেহে বলা যায় তৎকালীন চাকমা নেতৃত্ব ঐতিহাসিকভাবে সবসময় ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তারা ব্রিটিশ সরকারের সময় ব্রিটিশদের অনুগত ছিলেন এবং সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকারীদের গ্রেফতারে সরাসরি সহায়তা করেছেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল উপজাতি যখন ধর্মের ভিত্তিতে ভারতের অধীনস্ত হওয়ার জন্য মত প্রকাশ করেছিল, তখন তৎকালীন চাকমা রাজা নলিনাক্ষ রায় অন্যান্য উপজাতিদের মতামতের আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা না নিয়ে, ব্রিটিশদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তির বিষয়ে খুশি হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তান সরকারের অনুগত ছিলেন।

১৯৫৮ সালে যখন কাপ্তাই বাধ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন চাকমা নেতৃবৃন্দ তাদের জাতিগোষ্ঠীর কথা  বিবেচনা না করে পাকিস্তান সরকারের অনুগত হিসেবে অবস্থান নিয়েছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যখন পশ্চিম পাকিস্তানের একপেশে আচরণের কারণে স্বাধীনতা লাভের জন্য উন্মুখ ছিল তখনও চাকমা নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের অনুগত হিসেবে অবস্থান নিয়েছিলো। তৎকালীন চাকমা সার্কেল প্রধান স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার হিসেবে সক্রিয়ভাবে কাজ করার সময় যখন অনুভব করলেন পাকিস্তানের পরাজয় সুনিশ্চিত তখন তিনি পালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। এখানে যদি তিনি তার মাতাদর্শের বিষয়ে গুরুত্ব দিতেন তা হলে স্বপরিবারে পালিয়ে যেতে পারতেন, তা না করে বাংলাদেশে তার সম্প্রদায়ের অবস্থান ধরে রাখা এবং একই সাথে নিজে পাকিস্তানে অবস্থান করে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ব্যস্ত তখন চাকমাদের আরেক নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বঙ্গবন্ধুর স্নেহসুলভ একটি উক্তির (তোরা সব বাঙালি হয়ে যা) অজুহাতে শান্তিবাহিনী গঠন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। চাকমা নেতৃত্ব সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল শুধুমাত্র তাদের প্রতি করা বঙ্গবন্ধুর সেই সরল উক্তিকে তারা অহেতুক অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে। শান্তিবাহিনী সাথে সংঘর্ষে অসংখ্য পাহাড়ী, বাঙালি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্য নিহত হয়েছেন।

চাকমা নেতৃত্বের একাংশের স্বার্থপরতা এবং একপেশে নীতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপজাতি অধিবাসীগণ বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। চাকমা নেতৃত্ব কখনও অন্য জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের বিকাশ সহ্য করে না। চাকমা ব্যতিত অন্য জাতিগোষ্ঠির মধ্যেও যে মেধা রয়েছে তার অনেক উদাহরণ বর্তমান সমাজে রয়েছে। সামাজিকভাবে সহায়তার অভাব এবং পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষার প্রবৃদ্ধিতে বাধা সত্ত্বেও চাকমা ব্যতিত অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপজাতিগণ নিজস্ব মেধা ও শ্রম দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে।

খাগড়াছড়ির ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে, গুইমারাতে মারমা সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে এবং বান্দরবানে চাকমা ব্যতিত অন্যান্য সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এবং অধিবাসীগণও উল্লেখযোগ্যভাবে সমান তালে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তবে চাকমারা অযাচিতভাবে প্রভাব বিস্তার না করলে অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠির আরো এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো। চাকমাদের সৃষ্ট অশান্ত এই পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা স্বাভাবিক হলে অপার সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলে ব্যাপক হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটত।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন প্রকার কল-কারখানা, পর্যটনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটত। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক হতো। ঐতিহাসিকভাবে চাকমা নেতৃত্বের স্বার্থপরতাজনিত এই বিতর্কিত ভূমিকা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির স্বার্থবিরোধী হয়ে দেখা দিয়েছে।

চাকমা সম্প্রদায়ের ৪৬ ধরনের গোত্রের মধ্যে অধিকাংশ গোত্র সাধারণ উপজাতি ও বাঙালিদের সাথে মিলে মিশে এক সাথে কাজ করতে চায়। ঐতিহাসিকভাবে চাকমা সম্প্রদায়ের বিতর্কিত প্রশ্নবৃদ্ধ ভূমিকা সাধারণ পাহাড়ী, বাঙালিদের জনজীবন অতিষ্ঠ করাসহ দেশের সামগ্রীক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বার্থান্বেষী গুটি কয়েক চাকমা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের আচরণ এবং কার্যক্রমের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসছে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি পুনরুদ্ধারে এবং উক্ত অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য ব্যাপক শিল্পায়ন প্রয়োজন। যুগে যুগে চাকমা সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের স্বার্থপরতার জন্য উচ্চবিত্তদের সন্তানগণ শিক্ষার আলো পেলেও, সাধারণ পাহাড়ীদের সন্তানগণ শিক্ষাসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতি/গোষ্ঠী নিজ নিজ সম্প্রদায়ের জনগণের আগামী প্রজম্মকে উন্নত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চাকমা সম্প্রদায়ের চিহ্নিত কিছু নেতৃবৃন্দের নিজ জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের সাথে সহমত প্রকাশ না করে, নিজ দেশ বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেকে আরো উন্নত গর্বিত বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে, এই প্রত্যাশা সকলের।