রাজনীতিতে ‘নভেম্বর-ডিসেম্বর’ সংস্কৃতির পরিবর্তন

দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সে পরিবর্তন গুণগত নাকি উপরিতলে একটা দেখানো-পরিবর্তন সেটা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। জাগো নিউজেই এর আগে লিখেছিলাম যে, দীর্ঘ তিন মাসেরও বেশি সময় লন্ডনে কাটিয়ে বাংলাদেশে ফিরে বেগম জিয়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করে কক্সবাজার গিয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে।

যাত্রাপথে তার গাড়িবহরে হামলা থেকে শুরু করে যে সব কাণ্ড ঘটেছে তা আসলেই এড়ানো যেতো। সেটা সরকারের পক্ষ থেকেই হওয়া উচিত ছিল। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা দেশের ভেতর সফর করবেন তাতে বাধা দেওয়ার যে সংস্কৃতি এতোদিন তৈরি হয়েছিল তা থেকে না বেরুলে এর পরে অন্য কোনো সরকার এর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতে পারে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। তবে একথাও কেউ কেউ তর্কের খাতিরে বলতে পারেন যে, ক্ষমতাসীন সরকার ও রাষ্ট্রীয় মদদে ঘটা ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার চেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা আর কী হতে পারে? সেক্ষেত্রে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই বটে কিন্তু একথাও তো সত্য যে, এ ধরনের প্রতিহিংসার রাজনীতি আর কতোদিন চলবে এদেশে? এর থেকেতো মুক্তি প্রয়োজন দেশ ও জাতির, তাই নয় কি?

রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে সরকারের পক্ষ থেকে একটুখানি ছাড় দেওয়ার লক্ষণ দেখা গেলেও (যদিও ছাড় দিয়ে আবার বাধা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে) বিএনপি’র পক্ষ থেকে কোনো প্রশংসাসূচক বাক্য পাওয়া যায়নি কেবল নিন্দা ছাড়া

দীর্ঘকাল পরে ঢাকা শহরে বেগম জিয়া জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। তার জনসভায় লোক সমাগমে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপি’র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। টেলিভিশন ও গণমাধ্যমেও আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন জনে বলছে কী অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে তারা জনসভাস্থলে এসে পৌঁছেছেন। তার পরও বিএনপি’র স্মরণকালের রাজনীতিতে এতো বড় জনসমাগম আর হয়নি বলেই বলা যায়।

এই জনসভা একথাও প্রমাণ করে যে, জনসমর্থনে দলটি কারো থেকে পিছিয়ে নেই। একথা দলটি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই সত্য। এদেশে আওয়ামী-বিরোধী যে প্ল্যাটফরমটির নেতৃত্ব বিএনপি দিয়ে আসছে তা কোনো ভাবেই অগ্রাহ্য করার মতো নয়। কিন্তু তারপরও কেন দলটিকে নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র, মাগুরা বা ঢাকা-১০ উপনির্বাচনে বিপুল কারচুপি, ভোটারবিহীন একক নির্বাচন, কোটি কোটি জালভোটার সংযোজন কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করতে হয়ে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা টিকে থাকার জন্য সেটা রাজনীতিতে এক প্রবল বিস্ময়ের ঘটনা। আমি এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যদি বিএনপি নির্বাচনে যেতো তাহলে সে নির্বাচনের ফলাফল অন্যরকম হোতো, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু নির্বাচনে না গিয়ে নির্বাচনকে প্রতিহত করার যে প্রক্রিয়া বিএনপি গ্রহণ করেছিল তা ছিল আত্মঘাতী, আজকে সে কথাও বিএনপি’কে স্বীকার করে নিয়েই রাজনীতি করতে হবে। যদিও ঢাকায় অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য থেকে আমরা এমন কোনো কথাই শুনিনি। বরং তিনি তার বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ‘মানুষ’ বানাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কোনো বিশ্লেষণেই এই ঔদ্ধত্যকে প্রশংসা করা যায় না, যাবে না। কারণ যে ব্যক্তি বা নেতা তার নিজের দলতো দূরের কথা তার নিজের সন্তানকে সঠিক ও প্রশংসনীয় রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেননি তিনি কী করে আরেকটি রাজনৈতিক দলকে ‘মানুষ’ বানানোর দায়িত্ব নিতে পারেন?

বিএনপি’র জনসমাবেশকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল তা মূলতঃ দু’ধরনের। এক. বিএনপি’র ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীরা এতে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। দুই. সরকারের বিরুদ্ধে এই সমাবেশ আয়োজনে বাধা দেওয়ার অভিযোগ নিঃসন্দেহে সরকারকে জনমানুষের নিন্দার মুখে ফেলেছে, অর্থাৎ সরকার এখানে নাম্বার হারিয়েছে। ফলে এই আয়োজন থেকে বেগম জিয়া কী বলেন বা কী ভাবে তার সমর্থকগোষ্ঠীকে জাগিয়ে তোলেন তার দিকে সকলেরই দৃষ্টি ছিল। এমনকি অনেক সরকারি/বেসরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীও বেগম জিয়ার বক্তব্য শোনার জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের সমালোচনা সর্বসিদ্ধ একটি বিষয়। বেগম জিয়া সেটা করতেই পারেন এবং করেছেনও। মানুষের জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তা যদি কোনো সরকার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় তার সমালোচনা মূলতঃ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোই করে থাকে। কিন্তু সেই সমালোচনা যখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে তখন মানুষ যে দলটি সমালোচনা করছে তার শাসনামলকে স্মরণ করে তুলনামূলক বিশ্লেষণে মেতে ওঠে।

বলাই বাহুল্য যে, বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে তুলনা টানলে কোনোভাবেই, যে কোনো সূচকেই বেগম জিয়ার সরকার শেখ হাসিনার সরকারের তুলনায় পিছিয়ে পড়বেন। সেটা সরকার পরিচালনায় হোক, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হোক কিংবা বিদ্যুৎ বা জ্জ্বালানি সেক্টরের তুলনা হোক। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বিএনপি নেতৃত্ব বা বেগম জিয়া তাদের বক্তৃতায় কখনওই আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের তুলনা টানেন না, কারণ একথা সত্য যে, তারা এক্ষেত্রে কোনো কৃতিত্বই নিতে পারবেন না। সে কারণেই হয়তো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায়ও বেগম জিয়া এই সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা না করে সরকারের রাজনীতির সমালোচনা করেছেন, প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদদের হয়রানির কথা বলেছেন, যার সঙ্গে অনেকেই হয়তো একমত হবেন। কিন্তু সেসব কথা বলতে গিয়ে বেগম জিয়া যখন ঔদ্ধত্যভরে আওয়ামী লীগকে ‘মানুষ’ বানানোর ঘোষণা দেন তখনই মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে যে, তিনি তো নিজের দলকেই সামলাতে পারেননি, মানুষতো এখনও হাওয়া ভবনের দৌরাত্ম্য ভোলেনি, ভোলেনি দশ ট্রাক অস্ত্র কিংবা বাংলা ভাইয়ের আতঙ্ক। তাহলে তিনি কী ভাবে আরেকটি রাজনৈতিক দলকে ‘মানুষ’ বানাবেন?
বেগম জিয়ার বক্তব্যের সবচেয়ে প্রশংসিত বাক্য ছিল যে, তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। সত্যিই এদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা না থাকলে পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটতো না, ঘটতো না ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা বা আহসান উল্লাহ্ মাস্টার বা শাহ্ এ এস এম কিবরিয়া হত্যার ঘটনা। প্রতিহিংসার রাজনীতি না থাকলে হয়তো এদেশে গুমের রাজনীতিও হতো না। তার মানে এই ভয়ংকর রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতি টানতে হবে এবং সেটা সকল পক্ষকেই। বেগম জিয়া তাই এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কিন্তু বেগম জিয়া যখন তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে সেটা আদালতেই হোক আর জনসভাতেই হোক একথা বার বার বলেন যে, তিনি শেখ হাসিনাকে ‘ক্ষমা করে দিলেন’ তখন তার এই প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি মানুষের কাছে হাস্যকর হয়ে যায় কারণ শেখ হাসিনাকে তিনি ক্ষমা করতে চান কোন্ কারণে?

শেখ হাসিনার অপরাধটিই বা কি? আগে বেগম জিয়াকে স্পষ্ট করে শেখ হাসিনার অপরাধ সম্পর্কে জনগণকে জানাতে হবে এবং তারপর জনগণ যদি মনে করে যে শেখ হাসিনা সত্যিই কোনো অপরাধ করেছে তাহলে প্রথমে প্রশ্ন আসবে জনগণ শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করবে কিনা? যদি জনগণ ক্ষমা না করে তাহলে বেগম জিয়ার কোনো এখতিয়ার নেই শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করার। তার মানে বেগম জিয়ার এই বক্তব্য চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ এক ভাষণ যা আসলে প্রমাণ করে যে, বিএনপি তার অতীত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বা চায়ও না। মুখে বললেও কার্যতঃ দলটি ভবিষ্যতে ক্ষমতা পেলে এদেশের বহু মৌলিক চরিত্র বদলে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না যেমনটি করেছিল দলটির প্রতিষ্ঠাতা সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান।

শুরুতেই বলেছি যে, এদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন একটি সর্বজনকাম্য বিষয়। কিন্তু সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সর্বজনগ্রাহ্য অবস্থানে এসে দাঁড়িয়ে একত্রে তা কার্যে পরিণত করতে হবে। কিন্তু গত কয়েকদিনের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে সরকারের পক্ষ থেকে একটুখানি ছাড় দেওয়ার লক্ষণ দেখা গেলেও (যদিও ছাড় দিয়ে আবার বাধা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে) বিএনপি’র পক্ষ থেকে কোনো প্রশংসাসূচক বাক্য পাওয়া যায়নি কেবল নিন্দা ছাড়া। ফলে ধারণা করাই যায় যে, এরপর নতুন কোনো ছাড় দিতে সরকারের পক্ষ থেকেও হয়তো গড়িমসি হবে, যদিও দেশের একটি রাজনৈতিক দল তাদের স্বাভাবিক রাজনীতি করলে তাতে ছাড় বা বাধা দেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতিই যে আমাদের এখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটাও আমাদের মানতে হবে।

তবে এতোকিছুর পরেও একথা বলতেই হবে যে, বিএনপি’র সমাবেশ, বেগম জিয়ার বক্তব্য, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরির্দশন এবং নির্বাচন বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ রাজনীতিতে একটা গতির সৃষ্টি করেছে কোনো সন্দেহ নেই। এর আগে আমরা দেখেছি যে, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস এলেই এদেশে জ্বালাও-পোড়াও আর হরতালের রাজনীতি শুরু হতো। বেশ কয়েকবছর তার ব্যতিক্রম মানুষকে রাজনীতিতে সত্যিই আশাবাদী করে তুলেছে বলে মনে হয়, অর্থাৎ রাজনীতিতে নিশ্চিত ভাবেই নভেম্বর-ডিসেম্বর সংস্কৃতির একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। সরকারের উচিত হবে এই গতির বিপরীতে নিজেদের গতিও ত্বরান্বিত করা যাতে দেশের মানুষ আর সন্দেহে না ভোগে যে, নির্বাচন হবে তো? এখন দু’পক্ষেরই দায়িত্ব দেশের মানুষকে নির্বাচনমুখী করা, সকল ভয়-ভীতির উর্ধ্বে থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগে আশাবাদী করে তোলা। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে সবার আগে সেটাই প্রয়োজন।

যৌন কেলেঙ্কারি-আত্মহত্যা এবং ব্রিটেনের রাজনীতি

পশ্চিমা রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রেই প্রশংসিত, অন্তত দেশের মানুষের কাছে জবাদিহিতার প্রশ্নে শতভাগ স্পষ্ট থাকার চেষ্টা করেন এদেশের রাজনীতিবিদেরা। কোন রিউমার কিংবা নেতিবাচক প্রচারণায় রাষ্ট্রের কিংবা পার্টির দুর্নাম এসে যায়, এরকম জায়গায় রাজনীতির নীতি নির্ধারকেরা খুবই স্পর্শকাতর। পার্টি তখন ঐ নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না। এরকম পরিস্থিতিতে এসব নেতাদের টিস্যু পেপারের মতো উড়িয়ে দিতেও পিছপা হয় না দল। এবং এটা যত গুরুত্বপূর্ণ পদ হোক কিংবা ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হোন না কেন।

২) কিন্তু এবারের কেলেঙ্কারি’র ডাল-পালা এতটাই বিস্তৃত যে, ব্রিটিশ রাজনীতিতে যেন ‘চোর ধরতে গা উজাড়ে’র মতো অবস্থা। রীতিমত একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে ব্রিটেনের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে, যা সামাজিকভাবে ব্যাপক ধাক্কা দিচ্ছে। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের জীবন-যৌবন-বার্ধক্য এতে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তাদের অনৈতিক আচরণ গোটা রাজনীতির জন্যে একটা দুঃসংবাদ। তবে সুসংবাদ হলো ব্রিটিশ ব্যবস্থায় নারীরা আরও বেশি দৃঢ় হচ্ছে, কঠোর হচ্ছে, বিজয়ী হচ্ছে এবং পুরুষ রাজনীতিবিদেরা লজ্জা নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে প্রস্তুত হচ্ছেন। আর যার প্রথম বিদায়ী নেতা মাইকেল ফ্যালন।

‘অন্তত ৪০ জন মন্ত্রী-এমপি’র বিরুদ্ধে উঠেছে অভিযোগ। অবাধ যৌনাচারে পতিত নেতাদের নিয়ে মিডিয়া আর ব্রিটেনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন উত্তপ্ত ।’

টোরি সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী তিনি। একজন সাংবাদিককে যৌন সুড়সুড়ি দেয়ার দায় নিয়েই ডিফেন্স সেক্রেটারি ফ্যালনকে বেরিয়ে যেতে হলো সরকারের উচ্চাসন থেকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো ১৫ বছর আগে একজন নারী সাংবাদিকের হাঁটুতে বার বার হাত দিয়েছেন তিনি। বার বার উদোম হাঁটুতে হাতের স্পর্শ পাওয়া ঐ সাংবাদিক শেষ পর্যন্ত অবশ্য বলেছিলেন যে, ‘আমাকে চড় মারতে বাধ্য করবেন না’। ফ্যালনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত এই অভিযোগ আর তার পার্টির জন্যে যাতে বিষফোড়া না হয় সেজন্যে তিনি পদত্যাগ করলেন। কিন্তু বিষয়টা এখানেই শেষ হয় নি, অপরাধ স্বীকার করে গত বুধবার অর্থাৎ ১ নভেম্বর ফ্যালনের পদত্যাগের পর থেকে মিডিয়া পাড়া উষ্ণ হয়ে উঠে। একে একে আসতে থাকে নতুন কেলেঙ্কারির খবর। ক্যাবিনেট মেম্বার ডেমিন গ্রিন এমনকি থেরেসা মে’র ডেপুটি আছেন কেলেঙ্কারি তদন্তের তালিকায়।

অন্তত ৪০ জন মন্ত্রী-এমপি’র বিরুদ্ধে উঠেছে অভিযোগ। অবাধ যৌনাচারে পতিত নেতাদের নিয়ে মিডিয়া আর ব্রিটেনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন উত্তপ্ত । তটস্থ মন্ত্রী কিংবা সব দলের নেতা-নেত্রীরা। কারণ প্রধান দুটো দলেরই নেতা-নেত্রীরা এতে অভিযুক্ত হচ্ছেন। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, অভিযুক্ত এসমস্ত মন্ত্রী-এমপিদের অধিকাংশই কনজারভেটিভ পার্টির। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিব্রতকর অবস্থায় গোটা পার্টি। প্রধানমন্ত্রী ও পার্টির লিডার থেরেসা মে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, এবং নেতাদের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।

নেতা-নেত্রী কিংবা অভিজাতদের মাঝে ব্রিটিশ মূল্যবোধের স্থানটিতে সংঘাত চলছে তা থেরেসা মে তার এক বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছেন। সেজন্যেই তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে পারস্পরিক সম্মানের সংস্কৃতি (কালচার অব রেসপেক্ট) গড়ে তোলার উপর সাংসদদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর এ ইস্যু নিয়ে তাই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসবেন থেরেসা মে। ব্রিটিশ রাজনীতির একটা স্পর্শকাতর সময়ে বিরোধী দলগুলোও তাই থেরেসা মে কে সমর্থন জানাচ্ছে। সংকটময় এই বৈঠকে তাই যোগ দেবেন মে’র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি করবিনও। ব্রিটিশ রাজনীতিতে এতবড় যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেছে বলে কোন প্রমাণ নেই। ঘঠলেও তা আসে নি জনসমক্ষে। এই প্রথম এলো ব্রিটেনের জনগণের সম্মুখে।

৩) ব্রিটেনের সংস্কৃতিতে এরকম ঘটনা হয়ত নতুন নয়। সেলিব্রেটিরা বিভিন্ন সময় তাদের খ্যাতি দিয়ে বিভিন্ন সময় যৌনাচার চালিয়েছেন। কিন্তু ভয়ে-লজ্জায় অনেক অন্ধকারই আলোর মুখ দেখে নি। জিমি সাভিল ছিলেন ব্রিটেনের মিডিয়াপাড়ার এক বিখ্যাত মানুষ। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান রেডিও-টিভি প্রেজেন্টার। তার মুত্যু হয় ২০১১ সালে। তার দু’বছর পর এক বৃদ্ধা নারী প্রথম এই খ্যাতিমানের প্রতি অভিযোগের তীর ছুঁড়ে মারেন ২০১৩ সালে। পরবর্তীতে একে একে আসতে থাকে শতাধিক অভিযোগ। সেসময়ে গণমাধ্যমের সংখ্যা ছিলো সীমিত। সেই সীমিত গণমাধ্যমে তিনি ছিলেন জনপ্রীয়তার এক শীর্ষস্থানীয় তারকা।

অর্ধ শতাব্দীকাল তিনি ছিলেন কিশোর-যুবক-যুবতীদের নায়ক কিংবা সেলিব্রিটি। তার হাসিমাখা মুখ ছিলো তখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রধান চমক। অথচ তার হাসির পেছনে তিনি কত কদর্য আর নৃশংস ছিলেন তা বেরিয়ে আসে তার মৃত্যুর পর। একে একে বেরিয়ে আসে অনেক নির্মম সত্যগুলো, অকাট্য প্রমাণসহ। সহ প্রেজেন্টার থেকে শুরু করে তার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ৯ বছরের শিশু-কিশোরীদের সাথে জিমি পিড়ন করেছেন, যৌনাচার চালিয়েছেন। এমনকি মৃত মানুষের সাথে সাভিলের যৌনাচারের বিভীষিকাময় বিকৃতির ঘটনাগুলো আমরা হাল আমলে শোনলাম।

ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। কদর্যতা কেউ না কেউ জনসমক্ষে নিয়ে আসে। আর তাইতো আগামী পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় পাতায় জিমি সাভিল একজন পারভার্টেড, পিডোফাইল কিংবা সেক্স-ক্রিমিনাল । জিমি’র দ্বারা নিগৃহীত মহিলাদের এগিয়ে আসাটা ছিলো ব্রিটেনের ইতিহাসে এক সাহসী পদক্ষেপ। এর মানে এটা নয় যে, ব্রিটেনে এরকম কোন অপরাধের কোন বিচার হচ্ছে না। তা নয় অবশ্যই। যারাই বেরিয়ে আসছে, তাদের বিচারের জন্যে নিভৃতে কাঁদতে হয় না।

৪) সময়টা এভাবেই পাল্টাচ্ছে। নারীরা বেরিয়ে আসছে। কৈশোরে কিংবা যৌবনে যৌন পীড়ন পৃথিবীর সব জায়গায়ই কোন না কোনভাবে সংঘটিত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক জুনিয়রদের যৌন নিপীড়নটা করা হয় বিভিন্নভাবে। শিক্ষানবীশ হিসেবে কিংবা নতুনদের উচ্চাকাঙ্খার সুযোগকে এরা কাজে লাগায়। এদের ক্যারিয়ারকে পোক্ত করার নিশ্চয়তা দিয়ে ঐসব কথিত নেতারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে যৌন নিপীড়নের মাধ্যমে। একদিকে লজ্জা, অন্যদিকে ক্যারিয়ার ঐ দোদুল্যমানতার মধ্যে দিয়ে এরা পার করে বছরের পর বছর। কিন্তু যে ক্ষত নিপীড়িতদের হৃদয়ে লেগে থাকে সেই ক্ষত-চিহ্ন এদের যায় না, হয়ত সময়ের অপেক্ষা করে তারা। কিন্তু সুযোগ সবসময়র ধরা-ছোঁয়ার মধ্যেও থাকে না।

ব্রিটিশ রাজনীতিতে এবার সে সুযোগ এসেছে। তাইতো এমনকি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুপা হক পর্যন্ত অত্যন্ত সাহসের সাথে বলতে পেরেছেন, তিনিও যৌন নিপীড়নের শিকার। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি সেসময়ের-এসময়ের একজন খ্যাতিমান মানুষের হাতের পীড়ন থেকে রক্ষা করতে পারেন নি নিজেকে। কিন্তু এবার যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্ক্যান্ডাল বেরিয়ে আসছে একে একে, ঠিক তখনই তিনিও বেরিয়ে এলেন। এখনও নাম উচ্চারণ করেন নি। হয়ত তর তর কাঁপাছেন সেই মানুষটি এখন।

ব্রিটিশ রাজনীতির এই কাঁপন এখন গড়াচ্ছে মৃত্যুর যন্ত্রণায়। ওয়েলস এর সাবেক মিনিস্টার কার্ল সারজেন্ট এর বিরুদ্ধে অনৈতিক মহিলা পীড়নের অভিযোগ উঠেছে, এবং এটা তদন্ত চলছে। কিন্তু তদন্ত চলাকালীন সময়েই গত মঙ্গলবার কার্লের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে ওয়েলস এর পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

৫) খুব স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তি চলছে গোটা ব্রিটেনের রাজনীতির আকাশে। কনজারভেটিভ পার্টি এমনিতেই ব্রেক্সিট নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। ইউরোপের সাথে দেন-দরবার, দলের অভ্যন্তরে থেরেসা মে’র সংগ্রাম, লেবার পার্টি থেকে ব্রেক্সিটের বিরোধিতা প্রভৃতি নিয়ে থেরেসা মে কঠিন সময় কাটাচ্ছেন। এসময় যৌন কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত মন্ত্রী-এমপিদের অধিকাংশই তার দলের। দেশ আর জাতির কাছে মে’র দল-সরকার এখন প্রশ্নের মুখোমুখি। কি করবেন থেরেসা মে। বিরোধী দলের নেতাসহ অনুষ্ঠিতব্য রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে কি আসছে ঐ নেতাদের ভাগ্যে। রাজনীতি থেকে নেতারা বিদায় নেবেন না- কি সরকার হিসেবে দুর্বল হয়ে পড়বে ব্রিটেনের বর্তমান থেরেসা মে’র নেতৃত্ব। না-কি আগামীর নির্বাচনে টোরীর প্রস্থান হচ্ছে নিশ্চিত। জেরেমি করবিনই কি আগামীর ব্রিটেনের কান্ডারি , সে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে এখন ব্রিটেনের রাজনীতির আকাশে।

ধানের কাব্যের কবি

কার্তিক মাস শেষ হয়ে এলো প্রায়। অগ্রহায়ণ আসছে। আসছে নবান্নের দিন। বিশ্বজুড়েই হেমন্তকাল বা লেট অটাম কিংবা অটাম (শরৎ) হলো ফসল তোলার ঋতু। ধান উঠছে, ফসল উঠছে। এ মৌসুমকে বলা যায় হারভেস্ট টাইম। ফসল তোলার এই সময়টাতে প্রায় সব দেশেই রয়েছে নানা রকম লোকজ উৎসব। আমাদের দেশেও রয়েছে নবান্ন উদযাপনের সুপ্রাচীন রীতি। ফসল তোলার সময় মানুষ উৎসব করে কারণ শস্য বা ফসল মানুষকে জীবনদান করে, দান করে খাদ্য। মানুষের জীবন হরণ করার জন্য পাথরের মুষল থেকে শুরু করে তীরধনুক, তরোয়াল, বর্শা, কামান, বন্দুক, একে ফর্টিসেভেন, রাইফেল, মেশিনগান, এমনকি আণবিক বোমা অবধি রয়েছে।

বিশ্বের অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী ব্যস্ত রয়েছেন অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তৈরির গবেষণায়। যে সময় এ লেখাটি পাঠক পড়ছেন হয়তো সে সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে আরও নতুন কোন অস্ত্র। মানুষকে আরও সুচারুভাবে, নিপুণভাবে যন্ত্রণা দিয়ে ব্যাপকসংখ্যায় কিভাবে হত্যা করা যায় সে নিয়ে কোটি কোটি ডলারের গবেষণা চলছে। রাসায়নিক অস্ত্র, জীবাণু অস্ত্র, পারমাণবিক অস্ত্র সবকিছুই তৈরি হচ্ছে মানুষকে হত্যা করার জন্য। এসব অস্ত্রের আবিষ্কারক বিজ্ঞানীরাও বেশ নামীদামী। তারা নোবেল প্রাইজ পান, কোটি টাকা উপার্জন করেন। মানুষকে হত্যার জন্য আয়োজনকারীরা বিখ্যাত হলেও মানুষকে অনাহার থেকে বাঁচানোর জন্য যে মানুষটি সারা জীবন ব্যয় করেছেন, এখনও গবেষণা করে চলেছেন তার নাম আমরা ক’জনই বা জানি।

‘বিখ্যাত এই মানুষের জীবন যাপন খুবই সাদাসিধে। ১৯৬৪ সালে তিনি বিয়ে করেন তার সহযোগী তং চিকে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই তাদের জীবন ব্যয় করেছেন উচ্চ ফলনশীল ধানের গবেষণায়।’

ইউয়ান লং পিং এর নাম উচ্চারণ করলে আমাদের দেশের ক’জন মানুষই বা তাকে চিনবেন! অথচ এই মানুষটির জন্য বিশ্বে অসংখ্য মানুষ বেঁচে গেছে অনাহার থেকে। অসংখ্য কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসি। অসংখ্য শিশুর জীবন রক্ষা হয়েছে। সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে হুনান প্রদেশের ধান গবেষণা জাদুঘর দেখে পরিচয় পেলাম ধানের কাব্যের এই কবির। ইউয়ান লং পিং হলেন হাইব্রিড ধানের জনক। হুনান প্রদেশের রাজধানী ছাংশা বিশাল আধুনিক শহর। এখানে রয়েছে নতুন চীনের প্রতিষ্ঠাতা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মাও সে তুং এর স্মৃতিধন্য স্থাপনা। ছাংশা শহরে রয়েছে হাইব্রিড ধানের জনক ইউয়ান লং পিং এবং হাইব্রিড ধান বিষয়ক একটি জাদুঘর। বেশ বড় আকৃতির স্থাপনা।

ইউয়ান লং পিং এর জন্ম ১৯৩০ সালে বেইজিংয়ে। তবে তিনি হুনান প্রদেশে জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। তিনি একজন কৃষিবিদ। ১৯৫৩ সালে হুনানে কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু হয়। ষাটের দশকে চীনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। অসংখ্য মানুষ এ সময় মৃত্যু বরণ করে। একটু ভাতের জন্য মানুষের হাহাকার দেখে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন মানবদরদী লংপিং। তিনি ধানের ফলন বাড়ানোর সংগ্রামে নেমে পড়েন। তার কাছে মনে হয় বিশ্বে কোন মানুষ যেন অনাহারে মৃত্যুবরণ না করে। এটি নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন ফসলের ফলন এমনভাবে বাড়ানো যাতে বিশ্ব থেকে খাদ্যশস্যের অভাব দূর হয়।

কোন অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি নয় বরং ছোট্ট একটি কাঠের টেবিল, ছোট একটি ঘর, সাধারণ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম এই ছিল তার হাতিয়ার। মাঠে ঘাটে ঘুরে ধানের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করে তিনি বের করেন উচ্চ ফলনশীল ধানের সঠিক জাত। দীর্ঘ কয়েক বছরের গবেষণার ফসল নষ্ট হয়ে যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে। তারপরও ভেঙে পড়েননি এই মানুষটি। নিরলস পরিশ্রম করেছেন। সত্তরের দশকে আবিষ্কৃত হয় হাইব্রিড ধান। ১৯৭৯ সাল নাগাদ বিশ্বের অনেক দেশে লংপিং উদ্ভাবিত ধান ফলতে শুরু করে। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে তার উদ্ভাবিত ধানের চাষ শুরু হয়।

সারা চীনে ফসল উৎপাদনে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে যায়। বর্তমানে চীনের ৫০ শতাংশের বেশি ধান ক্ষেতে লংপিং এর হাইব্রিড ধান চাষ হচ্ছে। চীনের মোট ধান উৎপাদনের ৬০ শতাংশই লংপিং এর ‘সুপার রাইস’। ১৯৫০ এর দশকে চীনে যেখানে ৫৬৯ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন হতো সেখানে এখন ১৯৪৭ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদিত হচ্ছে। গত বিশ বছরে ৩০০ বিলিয়ন কিলোগ্রাম ধান বেশি উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। ৬০ মিলিয়ন মানুষকে খাদ্য জোগানোর জন্য এই উৎপাদন যথেষ্ট।

২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে লংপিং বলেন, বিশ্ব থেকে অনাহার দূর করতে হলে জেনিটিকালি মডিফাইড খাদ্য উৎপাদন ছাড়া উপায় নেই।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ইউয়ান লংপিংকে হাইব্রিড ধানের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। জীবদ্দশাতেই তিনি বিপুল সম্মান পেয়েছেন। পেয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সম্মাননা। তিনি ১৯৯১ সালে এফ এ ও( জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন)-এর প্রধান কনসালটেন্ট ছিলেন। তার কর্মযুদ্ধ নিয়ে স্থাপিত হয়েছে বিশেষ জাদুঘর। এটা কি কম প্রাপ্তি! গুণের সম্মান দেশবাসী তাকে দিয়েছে বলেই সে দেশে আরও গুণীর জন্ম হচ্ছে।

বিখ্যাত এই মানুষের জীবন যাপন খুবই সাদাসিধে। ১৯৬৪ সালে তিনি বিয়ে করেন তার সহযোগী তং চিকে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই তাদের জীবন ব্যয় করেছেন উচ্চ ফলনশীল ধানের গবেষণায়। এখনও প্রবীণ ইউয়ান লংপিং তার গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাষ হচ্ছে হাইব্রিড ধান। আমেরিকার কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক জরিপে দেখা যায় বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ ধানী জমিতে লংপিং এর সুপার রাইস চাষ হচ্ছে।

নবান্নের মৌসুমে ধানের কাব্যের এই কবির জীবন ও কর্ম নিয়ে কিছু কথা লিখলাম। হয়তো পাঠকের তেমন ভালো লাগবে না। কারণ এতে রোমাঞ্চকর তেমন কিছুই নেই। কিন্তু এই ধরনের কর্মযোগী ও মানবদরদী মানুষের প্রতি যতো শ্রদ্ধাশীল হবো ততো আমরা মানবিকভাবে সমৃদ্ধ হবো।

উপগ্রহের স্বপ্ন

জেফ আমার অফিসে এলে আমার অফিসের সহকারীরা সজাগ হয়ে যায়। ও একজন নভোবিজ্ঞানী সে কারণে নয়। তাদের সজাগ হওয়ার কারণ আমি জেফের সঙ্গে কথা বলার সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জেফ আমার এক যুগেরও বেশি সময়ের পরিচিত। ও আমার অফিসে এলে তার চিকিৎসা সেবার বাইরে বিস্তর আলাপ হয় আমাদের।

জেফের জন্ম ফ্রান্সে। ছোটবেলায় তার মা বাবার সঙ্গে আলাবামার একটি ছোট্ট শহরে চলে আসে তারা। তার বাবা ছিলেন গণিতের অধ্যাপক। মা কাজ করতেন ব্যাংকে। ছোটবেলা থেকেই জেফের স্বপ্ন ছিল নভোবিজ্ঞানী হওয়ার।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) অধ্যয়ন শেষ করেই নাসাতে গবেষণার কাজ পেয়ে যায় সে। নাসা অরলান্ডো থেকে চল্লিশ মিনিটের পথ। জায়গাটার নাম ‘কেপ কানেভেরাল’। আটলান্টিকের পাশে হাজার হাজার বর্গমাইল নিয়ে অবস্থান এ বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটির।

সারা জীবনের স্বপ্ন তার ধরা দিলো নাসাতে। দীর্ঘদিন কাজ করেছে নভোযান তৈরিতে। আমার মহাকাশ নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন। তার খানিকটার উত্তর সে আমাকে দিয়ে যায় মাঝে মধ্যে। জেফের সুবাদে দু’বার নাসার রকেট উৎক্ষেপণ দেখার সুযোগ পেয়েছি আমরা।

 

বছর চারেক আগে নাসার কাজ ছেড়ে ‘স্পেস এক্স’ নামের এক বেসরকারি নভোযান তৈরি করার প্রতিষ্ঠানে বড়কর্তার কাজ নিয়েছে সে। বেসরকারি খাতে নভোযান গবেষণার বিস্তর সুযোগ এখন। এমনকি নভোচারী না হয়েও এসব বেসরকারি নভোযানে চড়ে মহাকাশে ঘুরে আসা যায়, যদি অনেক টাকা থাকে।

এখন তার প্রতিষ্ঠান মহাশূন্যে উপগ্রহ পাঠাচ্ছে নিয়মিত। প্রথম উৎক্ষেপণটি সফল হয়নি তাদের। তবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাই ছিল, ‘না হারলে জিতবে কেমন করে?’

জেফ একদিন আমাকে বলেছিল প্রায় এক হাজার দুইশর মতো উপগ্রহ মহাশূন্যে আছে। অর্ধেকেরও বেশি উৎক্ষেপিত হয়েছে কেপ কানেভেরাল থেকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠানের উপগ্রহ এখান থেকে উৎক্ষেপিত হয়।

একদিন জেফ আমার অফিসে ফোন করে আমার সহকারীকে জানালো, আমি যেন তাকে সময় সুযোগ করে একটি ফোন করি। আমি ফোন করতেই প্রায় চিৎকার করে সে আমাকে জানালো তাদের প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের প্রথম উপগ্রহটি উৎক্ষেপণের দায়িত্বভার নিয়েছে।

 

আমি ভীষণ উল্লসিত। আমার আবদার সেই নভোযানটি দেখার। জেফ জানালো উপগ্রহের মূল অংশটি তৈরি হচ্ছে অন্য স্থানে। উৎক্ষেপণের নভোযানটি তৈরি করছে তারা। ভীষণ আগ্রহে আমাদের পুরো পরিবার দেখতে গেলাম সেটি।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এসেছিলেন নাসাতে। ভাগ্যক্রমে তার সঙ্গে কথা হয় আমাদের। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী স্বাধীনতার মাস মার্চে উপগ্রহটি উৎক্ষেপিত হবে। উপগ্রহের নাম ‘বঙ্গবন্ধু’। এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে?

স্বাধীনতার মাস মার্চে এক দল বাংলাদেশিদের নিয়ে নাসাতে যাবো বাংলাদেশের প্রথম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু’ উৎক্ষেপণের স্মরণীয় মুহূর্তটি মনে রাখার জন্য। সেদিন জোর গলায় গাইবো, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’

মওলানা ভাসানী : মিলিত সংগ্রামের নাম

আজীবন আপোসহীন, সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম আর জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মহান সাধক উপমহাদেশের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দিকের মধ্যে অতীব বৈশিষ্ট্য দিক হচ্ছে যে প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ ও পরিবেশের মাঝে তাঁর রাজনীতি সঠিকভাবে প্রয়োগে পিছ পা হতেন না। মওলানা ভাসানী এমনই একজন জাতীয় নেতা ছিলেন যার জীবন আলোচনা বাংলাদেশের অসমাপ্ত জাতীয় মুক্তি ও গণমুক্তি সংগ্রাম এবং সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী লড়াইকে শানিত ও শক্তিশালী করতে পারে।

দরিদ্র জনগোষ্ঠির জীবন মান উন্নয়ন ও সার্বিক সমাজ প্রগতি অর্জনে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল নিরলস। মওলানা ভাসানী আজীবন জমিদার-জোতদার-মহাজন-সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তির দালালদের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করেছেন, উপমহাদেশের আজাদী সংগ্রামে বৃটিশদের বিরুদ্ধে খেলাফত আন্দোলন, মুসলিম লীগ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামনের কাতারে থেকে লড়াই সংগ্রাম করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগ-আওয়ামী লীগ-ন্যাপ’র মত রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা, কৃষকদের অধিকার আদায়ে কৃষক সমিতি গঠন ও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও নেতৃত্ব প্রদান করেছেন।

আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দেশপ্রেমিক মহানায়ক হচ্ছেন মজলুম জননেতা। প্রতিটি সমাজ তার ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই জন্ম দেয় শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। আমাদের সমাজে এমনই একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান হচ্ছেন মওলানা ভাসানী

তিনি আজীবন লড়াই করেছেন সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, উপনিবেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, নব-সাম্রাজ্যবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা প্রতিষ্ঠার চক্রান্তের বিরুদ্ধে, সংগ্রাম করেছেন পাকিস্তানী আধা উপনেশিকতাবাদের কালো থাবা থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। বিশ্ব শান্তির জন্য তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টা, শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ধর্মান্ধতা ও ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মুখোশ উম্মোচন- কোথায় নেই মওলানা ভাসানী।

অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, সশস্র মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন, জনতার অধিকার আদায়, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকা-মানচিত্র রক্ষা, ভারতীয় পানি-সীমান্ত-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনতার সংগ্রাম-আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন তিনি। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী কেবলমাত্র একটি নাম নয়, এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি সমস্ত রাজনৈতিক মতপার্থক্যের গণ্ডিকে অতিক্রম করে আপামর জনমানুষের প্রাণের নিকটতম স্থানে পৌঁছেছিলেন। অনলবর্ষী বক্তা হিসেবে রাজনৈতিক সভা মঞ্চে তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ। শ্রোতার বুকে আগুন জ্বালিয়ে আন্দোলনে উজ্জীবিত করার জাদুকরি ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি।

জনগণের প্রতি মায়ের মমতা সিক্ত মনের অধিকারী মওলানা ভাসানী শুধু জনগণের জন্যই রাজা-মহারাজার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, শোষক-জোতদারের ধানের গোলা লুট করেছিলেন, বৃটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠন করেছেন, ৫৪ সালের মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়েছেন, ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলার মাধ্যমে বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্র শিখিয়েছেন- স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ৬৯-এর গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতা লাভের পর আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা সংরক্ষণে আপোসহীন চারণের মতো জীবনের মেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেকে নিঃশেষে নিবেদন করেছেন। রাজনীতিবিদ হয়েও তাই মানবতার এই মহান শিল্পী জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জনগণের সেবায় নিজের জীবন নিঃশেষে ব্যয় করে গেছেন, শিক্ষকের মতো নির্দেশ দিয়ে গেছেন।

প্রায় পৌনে এক শতাব্দি ধরে উপ-মহাদেশের নিপীড়িত, নির্যাতিত, অবহেলিত, অত্যাচারিত মানুষকে আশা-আকাঙ্খার বাণী শুনিয়েছেন, আপোসহীন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শাসকের ভ্রুকুটি, শত্রুর চোখ রাঙানি, জেলজুলুমের মুখে অকম্পিত হৃদয়ের বিশাল মহিরুহের মতোই যিনি এদেশের মানুষকে অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার বাণী শুনিয়েছেন তিনি হলেন অগ্নিপুরুষ মওলানা ভাসানী। আপোসহীন সংগ্রামের অগ্রদূত হিসেবে জাতিকে দিয়েছেন ৪০ দশকে বৃটিশ বিরোধী আজাদী আন্দোলন, ৫০ দশক ও ৬০ দশকে সর্বশেষ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্য রক্ষায় বারংবার তিনি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর সচেতনা ও সদাজাগ্রত কণ্ঠ বিভিন্ন সময়ের ক্রান্তিলগ্নে আমাদের আকাঙ্খিত পথের নিশানাই দেখিয়েছেন। তিনি এমনই এক সময় আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন যখন আমরা ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নের মুখোমুখি। সীমান্তে গোলোযোগ সৃষ্টি, ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে একতরফা গঙ্গা নদীর পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তেমনই সময় মওলানা ভাসানীর প্রয়োজনীয়তা ছিল সবচাইতে বেশি।

 

তাঁর বর্ণাঢ্য ও কর্মময় জীবন কাহিনী কথার মালা গাঁথিয়ে শেষ করা যাবে না। সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে শৈশবেই পিতৃহীন হন তিনি। অল্প বয়সেই বোগদাদের আত্মাধিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা শাহ নাসিরউদ্দিন বোগদাদী (রহঃ) এর সংস্পর্শে এসে তিনি নতুন জীবনবোধে অনুপ্রাণিত হন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের আসামে চলে যান। সেখানে তখন অসমীয় ও বাঙালি জনগোষ্ঠির মধ্যে খারাপ সম্পর্ক যাচ্ছিল। বাঙালি জনগোষ্ঠির অধিকার ছিনতাই করছিল শাসকগোষ্ঠি। আসামে গমন করে মওলানা ভাসানী লাইন প্রথার নিষ্পেষণে জর্জরিত বাঙালিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। তারই প্রেরণায় ও সংগ্রামী জীবনাদর্শের ডাকে নিপীড়িত জনতার মাঝে বিদ্রোহের অগ্নি জ্বলে ওঠে। কেপে উঠে বৃটিশ সরকারের ভিত। সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে কারাবন্দি করেন। বৃটিশ শাসনের অবসানের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ইতিহাসে যাদের নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত লেখা থাকার যোগ্য মওলানা ভাসানী তাদের মধ্যেই পড়েন। মূলতঃ তাঁর সংগ্রামী আন্দোলনের কারণেই সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়েছে। আজকে যা বাংলাদেশের অংশ।

ভাসান চরের ঐতিহাসিক সম্মেলনে মুগ্ধ আসামের নির্যাতিত নিপীড়িত জনতা তাকে ভাসানী উপরাধিতে অলংকৃত করেন। বৃটিশ কারাগার থেকে মুক্ত হয়েই মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবনের নতুন অধ্যায়। সত্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠির অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে ও বাঙালি জনগোষ্ঠির অধিকার আদায়ে সংগ্রামের সূচনা করেন এবং প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ যা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেন মওলানা ভাসানী। স্বায়ত্বশাসন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সাথে মতবিরোধ ঘটলে তিনি ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের আহ্বান করেন এবং সেখান থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠির অধিকার আদায় ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ গঠন করেন।

৫২‘র ভাষা আন্দোলন, ৫৪‘র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও স্বেচ্ছাচার বিরোধী ২১দফা সংগ্রাম, ৬২’ শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ৬৯’র আইয়ূব বিরোধী গণআন্দোলন, ৭১’এ মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৭২-৭৫ আওয়ামী দুঃশাসন বিরোধী সংগ্রাম, ৭৬’এ ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফারাক্কা লংমার্চে বলিষ্ট নেতৃত্ব দিয়ে লক্ষ কোটি মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। বস্তুত সুদীর্ঘ ৭৫ বছরের অধিককালে জাতীয় জীবনের এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নেই যেখানে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা নেই।

মওলানা ভাসানী প্রগতিশীল এবং শোষণমুক্ত সমাজ ধারার সাথে ধর্মের সুমহান আদর্শের রাখিবন্ধন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সারা জীবনের সংগ্রাম ছিল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষের মুক্তি ও কল্যাণ সাধনের। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ৯৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু অপ্রত্যাশিত না হলেও আকস্মিক ছিল। লক্ষ-কোটি মানুষের ভালবাসা নিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, প্রকৃত পক্ষে তিনি মৃত্যুবরণ করেননি, তিনি চির চিরঞ্জীব।

বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ নিমজ্জমান। বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ ভারতের বাজারে পরিণত করার চক্রান্ত চলছে। বাংলাদেশের উপর চলছে ভারতীয় আধিপত্যবাদীর পুঁজির আগ্রাসন। একই সাথে রাজনৈতিক আগ্রাসনের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানকালে একটা দেশ ও জাতিকে পদানত ও অধীনতাপাশে আবদ্ধ করা হয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে, সামরিক আগ্রাসন দিয়ে নয়। এমনই অধীনতায় প্রক্রিয়া বাংলাদেশে আজ আবারও চলছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে, যেমনটি হয়েছিল স্বাধীনতার পরবর্তী শাসনামলে। এমনই অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ আজ ভারতীয় সম্প্রসারনবাদের অধীনতা ও সকল প্রকার বিদেশি শোষণ-আধিপত্য মুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ জাতীয় মুক্তি ও জনগণের মুক্তি অর্জনের সংগ্রামে রত। এ সংগ্রামে দেশের জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা ও প্রেরণা গ্রহণ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দেশপ্রেমিক মহানায়ক হচ্ছেন মজলুম জননেতা। প্রতিটি সমাজ তার ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই জন্ম দেয় শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। আমাদের সমাজে এমনই একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। মজলুম জননেতা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে দলবদল করেছন, তৈরি করেছেন দল। কিন্তু, তার আদর্শ কখনো বদল করেননি। তাঁর স্বপ্ন সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদমুক্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে এতটুকু বিচ্যুত হননি। মজলুম জননেতাকে শ্রদ্ধা জানাবার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী লড়াইকে এগিয়ে নেয়া এবং সকল দেশপ্রেমিক শক্তির সৃদৃঢ় ঐক্য রচনা করা ও রক্ষা করা।

বাংলাদেশে তিনি সম্প্রসারণবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যের রাজনীতির সার্থক প্রয়োগ করেছেন। দেশপ্রেম, গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াবার সাহস, নির্যাতনের মুখেও অবিচলতা মানুষকে মৃত্যুঞ্জয়ী করে। মওলানা ভাসানী তেমনই একজন মানুষ। মওলানা ভাসানী সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় দেয়ার সময় এখন তো নয়ই, অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এই ভূখণ্ডের মানুষের আরো অনেক উত্থান-পতনের পরই শুধু অনাগত গবেষকদের পক্ষেই একটি আপাতত রায় দেয়া সম্ভব হতে পারে। এই জাতি আরো অনেক দুর্ভোগ পোহাবে, তারপরই শুধু উপলব্ধি করা সহজ হবে তাঁর কালে মওলানা ভাসানী অভ্রান্ত ছিলেন- না বিরোধী ও প্রতিপক্ষরা সঠিক ছিলেন।

পরিশেষে ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মজলুম জননেতা প্রদর্শিত পথ ভুলে গেলে কিংবা সেই পথ থেকে বিচ্যূত হলে জাতি হিসেবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, পতাকা-মানচিত্র রক্ষায় মজলুম জননেতার প্রদর্শিত পথে পরিচালিত হতে হবে।

ক্ষীণতর হচ্ছে সুস্থতার পরিসর

যখন অমর্যাদার মাত্রা জীবনের সব সীমা অতিক্রম করে তখন একান্ত নিজস্বতাটুকুও থাকেনা। তাদের সব গ্রাস করে নেয় চাড়ালরা। সংখ্যালঘুদের একমাত্র আশ্রয় জমি, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়ার চেষ্টা যখন সম্মিলিতভাবে হয় তখন তাদের আর কোনও উপায় থাকে না। তাদের সামনে বেঁচে থাকার অন্য কোনও বিকল্পও থাকেনা। সর্বনাশের এই তীরে আমরা যারা সহমর্মিতা জানাই তারা নিজেরাও আজ আক্রান্ত। এ এক ভয়ংকর খেলা। এই খেলার নিয়ম, সময় ও প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক যারা তারা ধর্ম ব্যবসায়ী এবং ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’, আবার এইসব অকল্যাণকারীদের জীয়নকাঠি।

অস্থিরতা ছড়াতে যারা সক্রিয় তারা কোন মতামত, কি তাতে বলা হয়েছে তার ধার ধারেনা। শুনেই সবকিছু ধ্বংস করতে পারে। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের পর রংপুরের তাণ্ডব দেখলাম আমরা। এমন অনেক ঘটনা হর হামেশা ঘটছে। আমাদের দীর্ঘ দিনের প্রচলিত ধারণা, উদারতা ও অসাম্প্রদায়িকতাকে দাঁড়াতেই দিচ্ছেনা একটি চক্র যারা মুখে আবার ইনসাফের বয়ান দেয়। ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করছে তাদের নানা পথ, নানা মত। কিন্তু পুরো সমাজকে কলুষিত করতে এরা এখন একত্রিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হিন্দুদের উপর, রক্তের খেলায় মেতে উঠতে ব্যবহার করছে ফেসবুককে। আবার যারা এসব ঘটনার নিন্দা করে তাদেরও সমস্বরে আক্রমণ করছে এই সভ্যতা বিরোধী শক্তি।

‘প্রশ্ন উঠে মুষ্টিমেয় বিপথগামী উগ্রপন্থীই কি তবে শাসনপ্রণালীর এজেন্ডা স্থির করে দিবে আর প্রশাসন সে অনুযায়ী চলবে? কিন্তু আমরাতো জানি জনসাধারণের মতপ্রকাশের, ভিন্নমত পোষণের কিংবা শুনবার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সাংবিধানিক দায় নির্বাচিত সরকার পরিচালিত প্রশাসনের।’

অপছন্দের মতামত দমন করার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো সেই মত পোষণকারী বা প্রচারকারীকে দমন করা। সবচেযে বড় অস্ত্র অশ্লীল কথা বলে মর্মে আঘাত করা। চাপটা এমন যে, যারা কথা বলার তারা হঠাৎই চুপ হয়ে যায়। নয়তো তার বিরুদ্ধে কেউ লেগে যাবে, তাকে ধর্মীয়ভাবে আঘাতের চেষ্টা হবে।

অসহিষ্ণুতা আমাদের দেশে পুরনো এবং পরিচিত ব্যাধি। যখনই কেউ বেচাল কথাবার্তা বলেছেন বা ক্ষমতাবানদের পক্ষে অস্বস্তিকর কোন কাজ করেছেন, বরাবর এবং বারবার তাদের দমনের ব্যবস্থা হয়েছে। গণতান্ত্রিক, খোলামেলা যুক্তির পরিসর সবসময় কাম্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই পরিসরটা এ দেশে প্রায় সর্বত্রই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।

এরা আক্রমণ করে, এরা উস্কানি দেয়, এরাই আবার ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বিবৃতি দিয়ে নিন্দা করে, বলার চেষ্টা করে সংখ্যালঘুরা আমানত। কিন্তু এই আমানতের খেয়ানতে তারাই সামনের কাতারের সৈনিক। তারা শান্তি চায় না, প্রগতি চায় না। চায় অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপ হোক, অশান্ততর হোক। এই মরণখেলায় কে হারে কে জেতে সে প্রশ্ন নেই। শুধু একটা কথা ঠিক, মরণখেলার উন্মাদনার চোটে ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে আমাদের সুস্থতার পরিসর।

অসংবেদী প্রতিক্রিয়ার ছায়া পড়ছে সবখানে। কোন কথা কারো জন্য অস্বস্তিকর হতেই পারে। কিন্তু ব্যক্তি আর গোষ্ঠীকে টার্গেট করে হেনস্তা করার মাঝে অসহনশীলতার সংস্কৃতির গন্ধ পাওয়া যায়। এই বাংলাদেশ থেকে লেখকদের এক সময় উন্মত্ততা দেখিয়ে বিদায় করা হতো। কিছুদিন চললো লেখক ব্লগারদের জবাই করা। লেখার জবাব লেখা দিয়ে দেয়া হয়নি। প্রয়োগ হয়েছে গায়ের জোর। কায়েমি স্বার্থান্বেষী মৌলবাদী ও রাজনীতিকদের সংগঠিত চক্রান্ত শুরু হয় যেকোন আলোকিত মানুষের বিরুদ্ধে যখন তখন। সমস্যা হলো, মৌলবাদি এই চক্রান্তের জালে পা দেয় উদারপন্থি দল, গোষ্ঠী এবং ব্যক্তিও।

প্রশ্ন উঠে মুষ্টিমেয় বিপথগামী উগ্রপন্থীই কি তবে শাসনপ্রণালীর এজেন্ডা স্থির করে দিবে আর প্রশাসন সে অনুযায়ী চলবে? কিন্তু আমরাতো জানি জনসাধারণের মতপ্রকাশের, ভিন্নমত পোষণের কিংবা শুনবার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সাংবিধানিক দায় নির্বাচিত সরকার পরিচালিত প্রশাসনের। আমাদের আসলে ঠিক করা প্রয়োজন- দেশ গণতন্ত্রে স্থিত থাকবে, না যূথবদ্ধ অন্যায়ের নিকট আত্মসমর্পণ করবে? সরকার কি বুঝতে পারছে এই গোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ মানে সর্বনাশের পথে হেঁটে যাওয়া?

আমাদের দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীটি উগ্র। এদের সাথে যোগ দিয়েছে একটা শিক্ষিত শ্রেণি যারা মুখে বড় পরিসরের কথা বললেও কাজে উল্টোটা করে। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে এরা চায় নিজেদের ‘মানুষ’, যারা তার হয়ে কাজ করবে। এই দর্শন চায় প্রশ্নহীন আনুগত্য। আর সেই চাহিদা না মিটলেই অসহিষ্ণুতা প্রকট হয়। তারা গালির বন্যা বইয়ে দেয় কারো দেয়ালে গিয়ে। তবুও শান্তির স্বার্থে নির্ভেজাল অন্যায়ের সামনে মৌন অবলম্বন করেই থাকতে হচ্ছে ভদ্র আত্মাদের।

এই গোষ্ঠী ধর্মের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির বিরোধ তৈরি করতে চায়। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে দেশে যেভাবে বিরোধিতা হয়েছে, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ আর সহিংসতা ছড়ানো হয়েছে সেগুলো ছিল জাতীয় স্বার্থ বিরোধী। একাত্তরের পরাজিত ঘাতক শক্তিই এই নব্য ধর্মীয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে লালন পালন করছে। এদের কেউ কেউ এক সময় প্রগতির রাজনীতি করেছে, কিন্তু অর্থের কাছে নিজেকে সঁপে চরম প্রতিক্রিয়াশীল হয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সামনে এরা বড় চ্যালেঞ্জ। অভীষ্ট অর্জনে সরকারকে প্রগতিশীলদের আরও কাছে টানতে হবে, বলার ও ভাবার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু উল্টোটাই বেশি লক্ষ্যণীয়। সরকারকে মনে রাখতে হবে উগ্রবাদীদের তোষণ করার নীতি বা কৌশল কোনও মঙ্গল বয়ে আনবে না। উগ্রবাদীদের ঔদ্ধত্যই কেবল বাড়বে, ঘটবে আরও রংপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো ঘটনা।

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশায় স্বাধীনতার রাজনীতিই আসল রাজনীতি। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা সেখানেই ভেদাভেদ ভুলে একটি সর্বমানুষের মিলনক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, একত্রিত হতে হবে। ওদের তোষণ করে শাসক গোষ্ঠীর বর্তমান ও আগামী কোনটাই নিশ্চিত করা যাবেনা।

ব্রিটিশ বাংলাদেশি প্রজন্মের চোখে জঙ্গিবাদ

ব্রিটেনে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতসহ মুসলিম তরুণদের অনেকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন আইএসকে। বিষয়টি সম্প্রতি ব্রিটেনে পরিচালিত একাধিক জরিপেও উঠে এসেছে। আইএস এর পুরো কর্মতৎপরতা সম্পর্কে তাদের অনেকের ই সম্যক ধারণা নেই। তবু, তারা মনে করছেন আফগানিস্তান, সিরিয়ার মতো দেশে দেশে সন্ত্রাসের নামে যুদ্ধের নামে নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে পশ্চিমা শক্তি। এক্ষেত্রে আইএস পাল্টা জবাব বা তাদের ভাষায় অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

ব্রিটেনে জন্ম, বেড়ে ওঠা স্বজন অনেকের সাথেই এসব বিষয়ে সুযোগ পেলে কথা বলি। স্পর্শ করতে চাই জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষিতে অনিরাপদ তাদের আপন জন্মভুমি ব্রিটেন নিয়ে, তাদের অনূভুতির জায়গাটুকু। তাদের অনেকের বক্তব্য, বিবিসি বা বিবিসির মতো পশ্চিমা বিশ্বের মূলধারার বেশিরভাগ মিডিয়া জঙ্গিবাদ বা ধর্মের নামে সন্ত্রাসের খণ্ডিত খবর প্রচার করছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। প্রজন্মের বড় একটি অংশের ভাবনা, সিরিয়ায় যখন মার্কিন বোমায় হাজার শিশু মারা যায় তা পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়া সঠিকভাবে তুলে আনে না। আসলে চোখ দিয়ে আমরা যা দেখি, সে চোখের দেখাতেও দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্যে খণ্ডিত দেখবার সুযোগ যে থাকে, তা বোধকরি সত্যি।

‘কাভার পিক আর প্রোফাইলে কাবা ঘর থাকলেও, ওয়ালময় নগ্নতা। হিজাব আর সেক্সি নারী দুটো আমাদের কামনা বলেই হিজাবকেও হতে হয়েছে সেক্সি লুকের অনুষঙ্গ।’

আজকে ব্রিটিশ মিডিয়ায় আলোচনায় ব্রিটিশ বিশ্লেষকরা বলেন, ব্রিটেনের আজকের ব্রিটিশ বাংলাদেশী প্রজন্ম আর সব এথনিক মাইনোরিটির মুসলমানদের মতোন আবেগ বা মনোজাগতিকভাবে সিরিয়া বা ফিলিস্তিনের মার খাওয়া মানুষের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ। ব্রিটেন যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে,অনেক ব্রিটিশ তখন নিজ দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছেন। অনেকের প্রকাশ্য অপকাশ্য সমর্থন রয়েছে। আর সে সহানুভূতির সুযোগটি আইএস বা জঙ্গি সন্ত্রাসীরা কাজে লাগাচ্ছে। আমার আজকের এ লেখার উদ্দেশ্য আজকের ব্রিটিশ তরুণ মুসলিমদের সে সহানুভূতি সৃষ্টির উৎসের সন্ধান। আশার কথা হল এটি, গত নির্বাচনে লেবার লিডার করবিনের মোহন বাঁশি ব্রিটেনের ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব প্রজন্মকে বাম ধারায় কিছুটা হলেও ফেরাতে পেরেছে। অন্ধ ডানের উল্টো ডানায় বিশ্বময় এখন ভর করেছে সন্ত্রাসবাদ।

সৌভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর পুঁজিবাদী পশ্চিমা বিশ্বের একটি শত্রু শত্রু খেলার প্রতিপক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আর পবিত্র ধর্ম ইসলাম একই সাথে ধর্ম ও রাষ্ট্রচিন্তা দুটিকেই ধারণ করে। এক্ষেত্রে তারা গণতন্ত্রের নামে প্রভাব আর অস্ত্রের খেলায় বেছে নেয় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে। লিবিয়ায় গাদ্দাফীকে উৎখাত করেছে পশ্চিমা বিশ্ব, গণতন্ত্র দেবার নামে। কিন্তু পুরো লিবিয়া জুড়ে আজ সংঘাত।

আফগানিস্তানে নজীব উল্যা সরকারকে উৎখাত করার পর খাল্ক এবং পারচম পার্টির লোকজন মোল্লা ওমরের তালেবান কিংবা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, গোলাম রব্বানীদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। মোল্লা ওমরাইতো আমেরিকার সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানব! একই ভাবে ইরাকে সাদ্দাম হোসেন এর সেনাবাহিনীর সদস্যরাও আমেরিকার সৃষ্ট আইএস এ যোগ দেয়। ইসলাম ধর্ম যেহেতু একই সাথে ধর্ম এবং রাষ্ট্রচিন্তার সে কারণেই পুঁজিবাদ ইসলাম ধর্মকে তাদের প্রতিপত্তি অব্যাহত রাখার জন্য প্রতিপক্ষ বানাতে সহজ হয়েছে। ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিধি নিষেধ, ইহুদী- খ্রীষ্টিয়ানদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি বিষয়কে সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছে । (খাল্ক এবং পারচম পার্টির তথ্যসূত্র নুরুর রহিম নোমানের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক লেখা)।

কিন্তু গণতন্ত্র আনার নামে লাখো মানুষের প্রাণ গেল দেশে দেশে গণতন্ত্র কি এসেছে। তরুণ প্রজন্মের ব্রিটিশ বাঙালিদের এমন কথার উত্তরে হয়তো তর্ক করা যায় আরো কিছুক্ষণ, কিন্তু সঙ্গত উত্তর দেয়া যায় না। একবার এক ব্রিটিশ বাংলাদেশী তরুণী যার জন্ম এদেশে সে আমায় চমকে দিয়ে বলেছিল, ব্রিটেন ছেড়ে দেশের বাইরে মাসখানেক থাকলে সে নাকি এ দেশের মাটির ঘ্রাণটা খুব মিস করে। ঠিক, ব্রিটেন তাদের জন্মভূমি। এ মাটিতে বড় হয়ে ওঠা, শৈশব কৈশোর সব তাদের। জন্মভুমির মায়ার টান পিছু ফেলে তবু কেন ২০১৪ বা ২০১৫ সালে বহু ব্রিটিশ বাঙালি স্কুল ছাত্রী সিরিয়ায় পাড়ি দিল প্রকারান্তরে নিজ মাতৃভুমির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে? মা-বাবা ভাই বোন,ক্যারিয়ারময় ভবিষ্যতের উজ্জ্বল হাতছানি সব পিছু ফেলে?

শুধুই কি কথিত ব্রেন ওয়াশ? নাকি এর নেপথ্যে বহুকাল থেকে জাল বিস্তার করা ভয়াল ষড়যন্ত্রের জাল। গত আট নভেম্বর কথিত জিহাদে আইএস এ যোগ দেয়া ব্রিটিশ বাংলাদেশী জয়া চৌধুরীর আমেরিকার দ্যা আটলান্টিককে সাক্ষাৎকারে ব্রিটেনে বর্ণবাদ নিয়ে খোলামেলা মন্তব্য করেছেন।ঐ সাক্ষাৎকারে জয়া বলেন, “লন্ডনে বেড়ে ওঠবার সময়ে এখানকার বর্ণবাদই তার মধ্যে মৌলবাদ এর বীজ বুনে দিয়েছে। আমার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ পরিবারকে বর্ণবাদীদের হাতে লাঞ্ছনার শিকার হতে দেখেই আমি ধীরে ধীরে মৌলবাদের পথে ঝুঁকে পড়ি। “লন্ডনে বেড়ে ওঠার সময়টা কঠিন ছিল। আমার পরিবার ছিল হতদরিদ্র,আমরা ছিলাম অভিবাসী দ্বিতীয় প্রজন্ম এবং চূড়ান্ত বর্ণবাদের শিকার। হীনম্মন্য প্রতিবেশিদেরকে আমাদের বাড়ির জানলা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে দেখেছি যখন, তখন থেকে আমার নিজেকে বহিরাগত মনে হতে শুরু করে। আমি হারানো সম্মান ফিরে পাবার একটা রাস্তা খুঁজছিলাম। আল কায়েদার ৯/১১ আক্রমণ এর সময় আমার বয়স ছিল ১৪ বছর, তার কিছুদিনের মাথায় কিশোরী থাকাকালীন একটি মৌলবাদী আলজেরীয় দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমার জিহাদি জীবন শুরু হয়।” ৩৩ বছর বয়সী জয়া বর্তমানে আমেরিকার টেক্সাসে বসবাস করছেন।

দুই
ব্রিটেনে কীভাবে একজন কিশোর বা তরুণ জঙ্গি হয়ে উঠেছে। তার পেছনে কী ধরনের ঘটনা বা প্রবণতা কাজ করেছে নীতিনির্ধারক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সন্ত্রাসবাদ দমনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা তো অবশ্যই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরাও এ বিষয়ে নিজেদের ব্যাখ্যায় উত্তর খুজঁবার চেষ্টা করেছেন, করছেনও। প্রথমত, এটি একটি প্রক্রিয়া; অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি হঠাৎই ধর্মের নামে সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে না। বরং এটি একটি প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়; অর্থাৎ এই পর্যায়ে যাওয়ার অনেক আগেই এর সূচনা হয় এবং বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে ওই তরুণটিকে সিরিয়ায় পাড়ি দিতে হয়। অথবা আবদির মতো ম্যানচেষ্টারে হাজার মানুষের খুনি হতে হয়। এই প্রক্রিয়া একরৈখিক নয়। এই প্রক্রিয়াকে আমরা বলতে পারি রেডিকালাইজেশন। ইউরোপের সমাজে বিরাজমান কিছু বাস্তবতা ও প্রবণতাকে কাজে লাগায় সন্ত্রাসের হোতারা। ব্রিটেনে আমাদের শিশুরা ঘরের বাইরে গেলে দেখছে অবারিত উন্মুক্ত জগৎ। সেখানে ঘরে ফিরলে থাকছে ধর্মীয়,সামাজিক,পারিবারিক অনুশাসনের অদৃশ্য বা দৃশ্যমান দেয়াল। আমাদের মা বাবারা এখনো সন্তানের সাথে অনেক বিষয়ে তাদের শৈশবে আলোচনায় সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এক্ষেত্রে অনেক প্রশ্নের প্রকৃত উত্তরের খোঁজ করতে নেমে শিশুটিকে ভ্রান্তিতে পড়তে হয়।

যে আরবী শিক্ষক বা প্রতিষ্টানে গিয়ে শিশুটি শিখছে সেখানে অনেক ক্ষেত্রে থাকছেন ভিন্ন মতবাদের শিক্ষক। মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি লিখেছে, বর্তমান বিশ্ব সৌদি আরবের ছড়িয়ে দেয়া সন্ত্রাসবাদের ফল ভোগ করছে। এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দৈনিকটি লিখেছে, ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য সৌদি আরব প্রচুর অর্থ খরচ করছে এবং দায়েশসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মূল চিন্তাদর্শন হচ্ছে ওয়াহাবি মতবাদ। সেখান থেকেই বাংলাদেশ থেকে বড় হয়ে আসা শিশুটি তার মা বাবার ধর্মচর্চার মতবাদ বা পদ্বতিগত পুরোনো প্রথাকেও কখনো ভুল হিসেবে পরিগণিত করে। আমাদের উপমহাদেশে ইসলামের আগমন সুফীবাদের পথ ধরে। অথচ ব্রিটেনের বহু মসজিদ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সৌদির দেখানো মতবাদকেই শুধুমাত্র সঠিক মনে করেন। অর্থাৎ এখানে ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ বা ভারতীয় মা বাবার সন্তানটির ধর্মচর্চায়। সন্তান ভাবছে, সে ই সঠিক। ধর্মের চর্চা আর আমাদের চিরায়ত বহমান বাঙালিয়ানার প্রথা কোন কোন ক্ষেত্রে যে সন্তান অভিভাবকের ক্ষেত্রে দূরত্ব তৈরি করছে না,তা নয় কিন্তু।

অবশ্যই ধর্মের অপব্যাখা একটি বড় কারণ। তরুণ ছেলে মেয়েদের অবদমিত কামনা বাসনাকেও কাজে লাগাচ্ছে এই বলে, ধর্ম রক্ষার জন্য যুদ্ধাবস্থায় এই অবদমিত কামনা বাসনা মেটানো পাপ নয়! ব্রিটেন এখন সারা বিশ্বের বহু ধর্ম বর্ণের মানুষের এক বৈশ্বিক রাষ্ট্র। শিশুটি যখন স্কুলে যাচ্ছে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় তার বন্ধু হচ্ছে বিভিন্ন দেশের অভিবাসী মুসলিম শিক্ষার্থীরাও। স্বভাবতই শিশুটির মধ্যে বন্ধুদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ভাবনা প্রভাব ফেলছে। ব্রিটেনে সোমালীরা যেভাবে সাজসজ্জা, জোব্বা বা হিজাব পরে, সেটিকে ইসলামী ফ্যাশনের পোশাক হিসেবে পরিগণিত করার ট্রেন্ড চলছে এখন। আর এ সুযোগে ধর্মকে পণ্য বানিয়ে বার্বিডলে হিজাব পরাচ্ছে পুঁজিবাদ। আর ব্রিটেনে যে বর্ণবাদ এখন বিলীন সেটিও নয়। বরং সাম্প্রতিক ম্যানচেষ্টার ও লন্ডন হামলার পর শ্বেতাঙ্গদের শারীরিক হামলার শিকার আর টার্গেটে পরিণত হয়েছেন মুসলিমরা। এ ধরনের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ নিগ্রহ শিশু মনে প্রভাব ফেলে নিঃসন্দেহে।

দ্বিতীয়ত, ধর্ম,অভিবাসী নিয়ে ক্ষমতাবানদের রাজনীতিও একটি কারণ। লন্ডনে আঞ্জিম চৌধুরীর মত ধর্মীয় উগ্রবাদীরা বরাবরই মাইক লাগিয়ে সন্ত্রাসবাদের উস্কানি দিয়ে গেছে এতকাল। তখন কি ব্রিটিশ সরকার আধো ঘুমে ছিল? আজ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ম্যানচেষ্টার ও লন্ডন ব্রিজ হামলার পর বলছেন, এনাফ ইজ এনাফ। এই বিলম্বিত বোধোদয় কেন?

২০০৬ সাল থেকে হোম সেক্রেটারি হিসেবে আজকের প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন ব্রিটেনের সেফটি-সিকিউরিটির দায়িত্বে। তার মেয়াদকালে কমপক্ষে ৪০০ ব্রিটিশ জিহাদী সিরিয়া থেকে ব্রিটেনে ফিরলেও সরকার আটকেছে মাত্র একজনকে। এখন দুর্বল এক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেবল মুসলিম নয় ব্রিটিশ জনগণের এমন প্রশ্নের উত্তর দেবার পথ খুজঁতে হবে থেরেসাকে। ব্রিটেনে গত কয়েক বছর ধরে সেবা খাতে অব্যাহত বাজেট কাটে ভুক্তভোগী হচ্ছেন বিপুল সংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষ। ডিজেবিলিটি এলাউন্সের মত সংবেদনশীল খাতে সরকার বাজেট কমিয়ে সে অর্থ ব্যয় করছে সিরিয়ার মতো দেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে! অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেশে ক্ষতিগ্রস্ত বাজেটের স্বল্পতায়। সেখানে বিদেশে মোড়ল সাজতে গিয়ে অস্ত্রবাজিতে অর্থব্যয় অন্যায় হিসেবেই দেখছেন বহু ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গও। পুলিশ পর্যাপ্ত সেবা দিতে পারছে না অর্থের সংকটে। এমন বাস্তবতায় বিদেশে শান্তি বা অশান্তি কোন যুদ্ধেই শক্তি বা সামর্থ্যের ব্যয়কে অপচয় মনে করছেন সাধারণ মানুষ। যেখানে ছেলে বা মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি যোগাতে পারছে না তবু সরকার ফি বাড়াচ্ছে। আর সে অর্থে ছুঁড়ছে বোমা। অস্বীকার করবার উপায় নেই, ব্রিটেন এখনো বিশ্বের অন্যতম অস্ত্রবিক্রেতা রাষ্ট্র। মারণাস্ত্র কি শান্তি আনতে পারে?

রাজনৈতিক সাম্যহীনতা, সামাজিক বঞ্চনা, অদৃশ্য বর্ণবাদকে যদি আমরা জঙ্গিবাদ থেকে একেবারে আলাদা করতে চাই ব্রিটেনের প্রেক্ষিতে, তবে সে বিশ্লেষণ পূর্ণাঙ্গতা পাবে না। ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত রিলেটিভ ডিপ্রাইভেশন বা আপেক্ষিক বঞ্চনার অভিজ্ঞতা বা বোধ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ বা তরুণদের হতাশার নেতিবাচক উপাদান। আপেক্ষিক বঞ্চনার বোধকে শিশুমন মারাত্বক প্রভাবিত করে। তরুণ বা শিশুটি যখন অন্যদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে এবং দেখতে পান যে অন্যরা তুলনামূলকভাবে ভালো আছেন, তখন তাঁর ভেতরে একধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এই ভালো থাকাটা হতে পারে বৈষয়িক, হতে পারে সাংস্কৃতিক, হতে পারে সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে। এই পার্থক্যকে যখন অন্যায় ও অন্যায্য বলে মনে হয়, তখনই এই পার্থক্যের বিষয়টি মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এই আপেক্ষিক বঞ্চনার বোধ তৈরি হয় যখন একজন ব্যক্তি দেখেন যে অতীতে যেসব অধিকার তিনি ভোগ করে এসেছেন তা সীমিত হচ্ছে বা অন্যরা এখন তাঁর চেয়ে বেশি অধিকার ভোগ করছেন। ইউরোপের মুসলিম সমাজের মধ্যে, এমনকি দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের ভেতরেও, এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা গেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সমাজে একীভূত হওয়ার বা ইন্টিগ্রেশনের অভাব। ভারতীয়রা যেখানে দ্রুতলয়ে মিলছে ব্রিটেনের মূলধারায়, সেখানে বাংলাদেশী পূর্ববর্তী প্রজন্ম এখনো নিজেদের কমিউনিটি সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত। ভুলের বেহালা আসলে একহাতে বাজে না।

ব্রিটেনের সমাজব্যবস্থায় এখনো অনেকে মনে করেন, সমাজকাঠামো ও বিরাজমান ব্যবস্থা তাঁকে ও তাঁর সম্প্রদায়কে আলাদা করে রাখছে এবং বঞ্চিত করছে। বাস্তবে বিরাজমান কিছু পরিস্থিতিই তাঁদের এই ধারণার জন্ম দেয়। বিশ্বময় আধুনিক জঙ্গিবাদের জন্য অনেকে রিলিজিয়াস ফ্যানাটিজম বা ধর্মীয় উন্মাদনার উগ্র উত্থানকে দায়ী করেন। কিন্তু আমি এটিকে একমাত্র কারণ হিসেবে দেখি না অন্তত ব্রিটেনের বাস্তবতায়। জঙ্গি মানসিকতার সৃষ্টিস্থল এবং কেন এ প্রণোদনায় কিছু মানুষ প্রলুব্ধ হচ্ছে, সেখান থেকে শুরু করতে হবে আমাদের। ইসলাম সব সময় সন্ত্রাসকে না বলেছে। ধর্মের নামে চরমপন্থার কথা পবিত্র কোরআনে কখনো বলা হয়নি।

ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় জীবন বিধানে চিত্ত বিনোদনের সুযোগের অপর্যাপ্ততার অনুযোগ, জিহাদের নামে সিরিয়া যাবার ভ্রষ্ট রোমান্টিসিজম, ধর্মের অপব্যাখ্যা আসলে সংকটের উপসর্গ, অসুখ নয়। কিছু মানুষের মনোবিকার,বিশ্ব রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে দেশে দেশে জঙ্গিবাদের প্রতি ক্ষমতার নেপথ্য আনুকূল্য আর বিভাজনের বৈষম্য পরিবেশে এবং পরিস্থিতি ভেদে ভিন্ন আঙ্গিক পায়। আর এসব উপাদানগুলোকে একত্র করে পুঁজির বহুল পেশি, মারণাস্ত্র বাণিজ্য, দেশীয়-আন্তর্জাতিক মহলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় আধিপত্যবাদের হোলিখেলা।

বিজ্ঞানও জঙ্গিবাদের সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ নির্ণয়ে অনেকখানি অক্ষম। পুঁজি আর পশ্চিমের সামাজ্যবাদ, সালাফী হানাফির পশ্চিমাসৃষ্ট সৌদি বিবাদ অবশ্যই ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের দায় এড়াতে পারে না। আবার এ বাস্তবতার উল্টোপিঠে আমরা দেখি ইসলামের নাম ভাঙ্গানো সন্ত্রাসের প্রকৃত স্বরূপ। আইএস যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ বিশ্বজুড়ে হামলা চালালেও তারা কেন ইসরায়েল নিয়ে টু শব্দটিও করে না? কেন তারা জিহাদের নামে পাশের ইসরাইলে হামলা চালাবার সাহস করে না! জঙ্গি সন্ত্রাসের মূল শক্তি সাম্যহীন ভঙ্গুর সমাজ। আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো দেশে দেশে জঙ্গিবাদ পরিপুষ্ট হচ্ছে বিদেশী এবং তাদের দেশীয় দালালদের অর্থনৈতিক অভিপ্রায় থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের তাগিদে।

তিন
জাতি হিসেবে সমান্তরালে অসম অদ্ভুত সব বৈপরীত্যকে আড়ালে আবডালে কখনো বা প্রকাশ্যে সমর্থন যোগাই আমরা। পাকিস্তান গড়তে এগিয়ে ছিলাম আমরা ভাঙ্গতেও। ব্রিটেনে ধর্মের নামে জঙ্গিবাদের শুরু ছিল পাকিস্তানি। আজ তারা সুকৌশলে পেছনে সামনে আমরা। আমরা এদেশে রোজগার করি, ওয়েলফেয়ার বেনিফিট পাই, এদেশের চার্চ কিনে মসজিদ বানাই। আবার ধর্মের নামে সন্ত্রাসীদের হাতে ব্রিটিশ জনগণ মারা গেলে অনেকে বলেন ‘প্রতিবাদ’। ফেসবুকে ইসলামিক পেজ আর ১৮ প্লাস পেজ দুটোতেই কিন্তু সমানে লাইক দিই আমরা। কাভার পিক আর প্রোফাইলে কাবা ঘর থাকলেও, ওয়ালময় নগ্নতা। হিজাব আর সেক্সি নারী দুটো আমাদের কামনা বলেই হিজাবকেও হতে হয়েছে সেক্সি লুকের অনুষঙ্গ। আমরা হালাল খুঁজি পণ্যের মোড়কে কিন্তু ‘হালাল’ সীসাবারে রাতভর চলে নেশা আর ফুর্তি। ছেলে মেয়েরা সেখানে একসাথেই থাকেন। ব্রিটেনে এখন আমরা নেশার মধ্যেও হালাল-হারামের ডেফিনেশন করে দিয়েছি। বলিহারী যাই এমত ধর্মচর্চার।

ক্ষমা করবেন প্রিয় পাঠক, সবার কথা বলছি না। ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছেন। কিন্তু ব্যতিক্রমের কী আর সাধ্য থাকে যাপিত বাস্তবতাকে অতিক্রম করবার।

সাংবিধানিক প্যাঁচালে প্যাঁচ শুধু বাড়েই

বি. চৌধুরী বিষয়ক প্যাঁচাল এখন তামাদি। এসকে সিনহা ক্যাচালও শেষ। ল্যাঠাও মিটে গেছে বলা যায়। কিন্তু শেষ হয়েও এ ধরনের কেস কি শেষ হয়? এর জের সইতেই হয়। এতে নানান নাকানি-চুবানিতে নির্দিষ্ট ব্যক্তিটির বিদায় ঘটে। তিনি হেরেছেন মনে করা হয়। কিন্তু জয় হয় কার? বরং ক্ষয় নিশ্চিত হয় অনেকেরই। হারে বাদবাকি সবাই। এমনকি তা মন্দ রেওয়াজ হিসেবে গেঁথে যায় দেশের ইতিহাসে। এছাড়া এ নিয়ে কথামালা গড়ায় সংবিধানের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে ঘাটে-মাঠেও। যার মন যা চায়, তাই বলেন। বক্তার পক্ষে সমর্থকও থাকে প্রচুর, অগুনতি। অযুতে-নিযুতে। নানা রটনা-ঘটনায় সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে নিয়েও তা-ই হয়েছে। এখনো হচ্ছে। চলছে হরদম। কথার সঙ্গে আকথা, প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে অপ্রাসঙ্গিক নানা কথার সঙ্গে গুজবও অন্তহীন।

অনেকের মনে থাকার কথা বিএনপি-জামায়াত আমলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বি. চৌধুরীকে বিদায় এবং রাজপথে তাদের বাপ-বেটাকে ধাওয়ানোর কথা। বি. চৌধুরীকে ওই দৌড়ে হারানোর কাজটি করতে পেরে তখনকার শাসক শ্রেণি নিজেদের বিজয়ী ভেবেছে। আসলে কি বি. চৌধুরী একাই হেরেছিলেন? সেই দায় কি আজও টানছে না বিএনপি? ভুগছে না সেই পাপে?

‘অনেকের মনে থাকার কথা বিএনপি-জামায়াত আমলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বি. চৌধুরীকে বিদায় এবং রাজপথে তাদের বাপ-বেটাকে ধাওয়ানোর কথা। বি. চৌধুরীকে ওই দৌড়ে হারানোর কাজটি করতে পেরে তখনকার শাসক শ্রেণি নিজেদের বিজয়ী ভেবেছে। আসলে কি বি. চৌধুরী একাই হেরেছিলেন? সেই দায় কি আজও টানছে না বিএনপি? ভুগছে না সেই পাপে?’

উপরের দুই ঘটনার চেয়ে কিছুটা ভিন্নমাত্রার এমন আরেকটি সাংবিধানিক হারজিতের খেলা ঘটেছে ২০০৭ সালে। বহুল আলোচিত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজকে খেদানো হয়েছিল গোটা কমিশনসহ। ১০ বছর আগে নবম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের ঘোষণা করেছিল আজিজ কমিশন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তখন নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে প্যাঁচের মধ্যে পাকিয়ে বসেন আগামাথাহীন নতুন প্যাঁচালি। এরপরই ওয়ান ইলেভেন।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমন। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে ফখরুদ্দীন আহমদ। পরে শুধু তফসিলই বাতিল হয়নি। কমিশনকেও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এতে তখনকার বিরোধীপক্ষ নিজেদের বিজয়ী ভাবে। আর বিচারপতি আজিজসহ তার কমিশনের সদস্যরা এখন পর্যন্ত অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই। অফ দ্য রেকর্ডে তারা তখন বলে গিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে এ দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ভাগ্যে অনেক দুর্গতি আছে। বদদোয়া বা ভবিষ্যৎদ্বাণী যা-ই হোক কথাতো বেঠিক বলে যাননি তারা। নইলে কেন নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন প্রশ্নে আজও দুর্ভোগের সাগরে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে তখনকার হারা-জেতাসহ গোটা দেশকে?

রাজনৈতিক-সামাজিক, পারিপার্শ্বিক নানা ঘটনা- দুর্ঘটনার মাঝে বাংলাদেশ নতুন করে সাংবিধানিক প্যাঁচে পড়লো প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ইস্যুতে। একসময় বলা হয়েছে তিনি প্রাজ্ঞ, দক্ষ, সৎ, সাহসী, বিচক্ষণ আরো কতো কী? একজন সংখ্যালঘু বা হিন্দুকে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রধান বিচারপতি করে কতো বাহবাই না কুড়ানো হলো। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে সব উল্টে গেল। তিনি হয়ে গেলেন অসৎ। এমনকি রাজাকারও। আবার তিনি আসলে হিন্দুও না-এমন তথ্যও হাজির করা হয়েছে।

দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থনৈতিক অপকর্ম, নৈতিক স্খলনসহ ১১ অভিযোগ প্রচারও বাদ পড়েনি। মোটকথা তাকে মানুষের জায়গায়ই না রাখার যাবতীয় বন্দোবস্ত করে ফেলা হয়। শেষমেষ ক্যান্সার রোগী বানিয়ে দেশ ছাড়া। ছুটির আবেদন, চিকিৎসার্থে বিদেশ যাত্রার আবেদন, শেষমেষ বিদেশ থেকে পদত্যাগপত্র। প্যাঁচাল-ক্যাচালের আর কিছুই বাকি রাখা হলো না। এসবের সত্যতা প্রমাণের জন্য আইনমন্ত্রীর দাবি, তিনি ইহজীবনে কখনো মিথ্যা বলেননি। মানুষ যা বোঝার বুঝেছে। সরকার আরেকটু বেশি করে বুঝিয়ে ছেড়েছে। আর আনলিমিটেড বিনোদনতো দিয়েছেই। একদিকে আইনমন্ত্রীসহ সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা সংবিধানের ছবক শোনাচ্ছে প্রতিদিন। মানুষ একদিকে বিনোদিত হচ্ছে। আরেকদিকে কথা-আকথা গুজব-গুঞ্জনও চলছে ফ্রিস্টাইলে।

সংবিধানে কি আছে, আর কি নেই অল্পশিক্ষিত মানুষও এতোদিনে তা কম-বেশি বোঝে। অন্তত নিজের বুঝের জন্য কারো কাছ থেকে বুঝজ্ঞান হাওলাত করে না। বা করতে হয় না। সেইসাথে ভালো করেই জানে, ক্ষমতার ওপর কোনো দাওয়াই নেই। রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি আর প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বহাল রাখার বিধি যেমন আছে, তেমন আছে খেদানোর বিধানও। আর রেওয়াজতো চালু হলোই। পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করে ক্ষমতার ওপর। আমাদের আঞ্চলিক বাংলায় যাকে বলে, সেরের ওপর সোয়াসের। মাইরের ওপর দাওয়াই নাই।

শুনতে হালকা বা হাস্যকর মনে হলেও কথাটি একদিকে রুঢ় সত্য। আরেকদিকে নিষ্ঠুরতায় ভরা। আর দেশের জন্য আপদের। ভবিষ্যতের জন্য বিপদের। এসকে সিনহাকে সরকার কিভাবে, কোন ভয়ে হটিয়েছে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষেরও জানার তেমন অবশিষ্ট নেই। যদিও সরকার বেশ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। আইনমন্ত্রী অত্যন্ত কনফিডেন্সের সঙ্গে বলেছেন, বর্তমানে প্রধান বিচারপতি নেই। এটা কোনো সমস্যাই না। সংবিধানে প্রধান বিচারপতি অনুপস্থিতিতে বা পদত্যাগ করলে কী হবে বা কে দায়িত্ব পালন করবেন, সংবিধানে তার সব ব্যবস্থা আছে।

কথা বড় সুন্দর। চমৎকারের চেয়েও চমৎকার। কিন্তু বিচারপতি এস কে সিনহাই কি শুধু হারলেন? সরকার চিরঞ্জীবের মতো জিতে গেছে? ক্যান্সারের কী হবে? কার ক্যান্সার কাকে ধরবে কি-না কে জানে? তার বিরুদ্ধে আনা ১১ অভিযোগের কী হবে? এই নরাধম বিচারপতির মৃত্যুদণ্ডসহ দেয়া রায়গুলোর যৌক্তিকতা দাঁড়াবে কোন মানদণ্ডে? এছাড়া প্রধান বিচারপতির বিতর্কিত সইযুক্ত ভুল বানান ও ভুল বাক্যে ভরা দুটি চিঠির একটিতে অসুস্থ, অন্যটিতে সুস্থ থাকা, লম্বা ছুটিতে স্ত্রীকে ছাড়াই একাকী যাত্রা, চাপে না স্বেচ্ছায় যাওয়া ও বিব্রত- শঙ্কিত হবার কথা বলা, ভুল বোঝাবুঝির শিকার হওয়া ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গের নিস্পত্তি তো হলোই না।

প্রসঙ্গক্রমে অধ্যাপক এ কিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বিতাড়নের কথা এসেই যায়। যার বিস্তারিত বিবরণ ও পরিণতির উল্লেখ রয়েছে বাংলাদেশের (১৯৯১-২০০৬) রাজনীতির ওপর ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র’ নামে লেখা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বইতে। ‘বাংলাদেশ : এ স্ট্যাডি অব দ্যা ডেমোক্রেটিক রেজিম’ শিরোনামে ইংরেজিতে লেখা তার বইটির প্রথম প্রকাশ ২০১২ সালে। সরকার ও বিরোধী দলে থাকাবস্থায় একজন সমালোচনামূলক রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বইটি লেখেন তিনি। যা নিয়ে চরম আপত্তি তার দলের। কিন্তু তিনি বক্তব্যে অটল থেকে টিকে আছেন এখনো।

‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র’ বইয়ের ৩৮৫ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যখন লাইফবয় সাবান কিংবা শপিং কমপ্লেক্সের মতো ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন বা উদ্বোধনের মতো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে থাকেন এবং সেসব খবর প্রচারমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে, তখন তারা সবাই একে রাষ্ট্রপতির কার্যধারার মধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে মনে করতে থাকেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী একই দিনে দুটি পৃথক স্থানে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে মিডিয়া কাভারেজে প্রধানমন্ত্রীর চাইতে প্রটোকল অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়।

এতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মনে করা হতে থাকে যে, প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। ফলে রাষ্ট্রপতি ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে হাওয়া ভবনের উদীয়মান তরুণ গ্রুপ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বদরুদ্দোজা চৌধুরীবিরোধী একটি প্রচারণা শুরু হয়। এই অনুমিত বিচ্যুতির বিষয়টিকে সমাধানের জন্য কোনো পক্ষ থেকেই কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ ধরনের মধ্যস্থতাকারী উদ্যোক্তার অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতি দিন দিন বরং আরও খারাপের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

সংবিধান বা সাংবিধানিক বিষয় নিয়ে অতি রাজনীতি ও কথার কচলানির কী পরিণতি হয় বা হতে পারে ব্যারিস্টার মওদুদের বইয়ের একটা প্যারাই যথেষ্ট তথ্য দেয়। সুস্থ, বিবেকমান যে কারোই কামনা থাকবে, উপরোক্ত খারাপের দিকে আর না যাক বাংলাদেশ। রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনায় আইন প্রণয়ন, আইনী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আইনের উৎস বিষয়ে নানান গুরুত্বপূর্ণ অনুমান ও দার্শনিকতা এই সংবিধানকে ঘিরে বহাল থাকুক। প্যাঁচও থাকুক। কিন্তু প্যাঁচাল-ক্যাচাল যেন মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে-রটিয়ে আপদের সাথে নতুন বিপদ আর না আনে।

প্রশ্নফাঁসের হোতারা ধরা পড়বে তো?

এটা খুবই দুঃখজনক যে প্রশ্ন ফাঁসের মত গুরুতর অপরাধের ঘটনা ঘটেই চলেছে। নানা রকম উদ্যোগ স্বত্ত্বেও প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো যাচ্ছে না। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হচ্ছে। সবশেষ বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) নার্স নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সিনিয়র দুই নার্স মো. আরিফুল ইসলাম ও মো. সাইফুল ইসলামকে তিন দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। ১৬ নভেম্বর মহানগর গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের (উত্তর) মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও প্রতিরোধ টিমের বিশেষ দল এ দুজনকে ফাঁসকৃত ১১ সেট প্রশ্নসহ রাজধানীর শাহবাগের স্মৃতি চিরন্তনের পূর্বপাশ থেকে গ্রেফতার করে। কিন্তু এতেই কি সমাধান মিলবে?

গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, গত ৬ অক্টোবর রাজধানীর ১০টি কেন্দ্রে মোট চার হাজার ছয়শ সিনিয়র স্টাফ নার্স (ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি তিন হাজার ছয়শ ও মিডওয়াইফ এক হাজার) নিয়োগ পরীক্ষার বিপরীতে ১৬ হাজার নয়শ’ জন অংশগ্রহণ করেন। শিউলি, হাসনাহেনা, রজনীগন্ধা, কামিনী নামে চার সেটের প্রশ্নপত্র ছাপে পিএসসি। কিন্তু সব সেটের প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পরীক্ষার আগে পাওয়া যায়। একাধিক পরীক্ষার্থী অভিযোগ করেন, পরীক্ষা শুরুর আগে ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাওয়া যায়। পরীক্ষার হলে গিয়ে তারা দেখেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পিএসসির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক প্রথমে বিষয়টি গুজব বলে উড়িয়ে দেন। পরবর্তীতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পেয়ে অনিবার্য কারণে পরীক্ষা বাতিল করে পিএসসি কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়।

‘সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সর্ষের ভেতরের ভূত আগে তাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ কোনো সহযোগিতা ছাড়া প্রশ্নফাঁস অসম্ভব ব্যাপার। আর মূল হোতারা ধরা না পড়লে সমস্যার সমাধান হবে না।’

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রশ্নফাঁসকারী একাধিক চক্র বিরাজমান। তারা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে। তারা প্রযুক্তির অপব্যবহার করেও প্রশ্ন ফাঁস করছে। এদের পেছনে শক্তিশালী হাত থাকাও অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। অভিযোগ আছে সর্ষের ভেতরেই রয়েছে ভূত। নাহলে এই চক্রকে কেন সামাল দেয়া যাচ্ছে না। প্রশ্নফাঁসের কারণে দেখা দিচ্ছে বিশৃঙ্খলা। পরীক্ষার্থীরা নানা রকম গুজবে কান দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অভিভাবকরাও যার পর নাই চিন্তিত। এ অবস্থায় যে কোনো মূল্যে প্রশ্ন ফাঁস রোধ করতে হবে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধানসহ আইন রয়েছে। কিন্তু সেই আইনে কারো সাজা হয়েছে এমন নজির মেলা ভার। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন ছাড়া সমাজে আইন প্রতিষ্ঠা কঠিন। যত ব্যবস্থার কথাই বলা হোক না কেন অপরাধীর শাস্তি না হলে কোনো অবস্থায়ই অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সর্ষের ভেতরের ভূত আগে তাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ কোনো সহযোগিতা ছাড়া প্রশ্নফাঁস অসম্ভব ব্যাপার। আর মূল হোতারা ধরা না পড়লে সমস্যার সমাধান হবে না। এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রশ্নফাঁস রোধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

পেশার দ্বন্দ্ব

পেশা নিয়ে সম্মান-অসম্মানের ধারণা সমাজে বহুযুগ থেকে চর্চিত। শিশুকালেই আমাদের বলা হয়ে থাকে যেভাবেই হোক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লইয়ার, ব্যাংকার, মিলিটারি কিংবা পুলিশ অফিসারের মতো সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত হতে হবে। অর্থাৎ অন্য পেশাগুলো যে অসম্মানের সুস্পষ্টভাবে সেই ধারণাই দেন অভিভাবকরা।

সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন বিভেদ, বিদ্বেষ, ঘৃণা ও শ্রেণি বৈষম্যের একটি প্রধান কারণ পেশা বিষয়ক প্রচলিত এই ধারণা। এর ফলে বড় হয়ে কেউ নিজেকে সম্মানজনক পেশার লোক ভেবে অহংকারী হয়। আর কেউবা নিজের পেশাকে অসম্মানজনক ভেবে হীনম্মন্যতায় ভোগে। অহংকারীরা কারণ-অকারণে অন্যদের তুচ্ছজ্ঞান করেন আর হীনম্মন্যতার শিকার মানুষগুলো সারাজীবন জড়ো পদার্থের মতো বাঁচেন। যেমন চিকিৎসায় অবহেলার কথা আসলেই কিছু ডাক্তার নাখোশ হন। মানবিক চিন্তা বিসর্জন দিয়ে কর্মবিরতি ডেকে বসেন। রোগীকে জিম্মি করে দাবিও আদায় করেন।

‘আপনি একজন কাস্টমস অফিসার বা যে কোন অফিসের একজন অফিসার। আপনি দু’হাতে ঘুষ খান। মানুষ কি আপনাকে সম্মান করবে? ডাকাতের সামনে কেউ যদি হাতজোড় করে দাঁড়ায়, কেউ কি বলবে যে-সে ডাকাতকে সম্মান করছে?’

সংবাদকর্মী হিসেবে এসব ঘটনা পাঠকের কাছে তুলে ধরা আমার দায়িত্ব। আমি চেষ্টা করি শতভাগ নিরপেক্ষ থেকে অভিযোগের ভিত্তিতে বর্ণনা করতে। এক্ষেত্রে রোগী বা তার স্বজনদের ভুল-ত্রুটিও আড়ালে থাকে না। কিন্তু রিপোর্ট ছাপা হলেই আমাকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আসে। কেস না বুঝে রিপোর্ট করার অভিযোগও করেন। দম্ভ নিয়ে অনেক ডাক্তারকেই তখন বলতে শুনি আরে তিনি তো বকলম সাংবাদিক। বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে পিছে লেগেছে। পেশা নিয়ে অহংবোধে শিক্ষকরাও কম যান না। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে অনিয়ম, প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি, দলাদলি, গবেষণা কর্মে কাট-কপি, মারামারি-হাতাহাতিসহ নানাবিধ অনিয়ম-অনাচারের কথা বললে তাদের অনেকে একরকম তেড়ে আসেন।

সাংবাদিকতার এথিক্স নিয়ে নতুন করে পাঠ দেন। এসব নিউজ করার কী আছে এমন দাবিও করেন। মনে মনে যে গালমন্দ করেন তা আর বলার অবকাশ রাখে না। বিশেষ বিশেষ পেশার মানুষ তো আরো একধাপ এগিয়ে। অনিয়মের কথা আসলে প্রতিশোধ নেয়ার সংকল্পে তারা দাঁতের মাড়ি শক্ত করে রাখেন। সুযোগ বুঝে পেটে লাথি মারতেও কুণ্ঠিত হন না। বড় হাতের ইশারায় চুটকিতে এই নগণ্য কাজ সেরে ফেলেন। পরে আলোআঁধারে চিয়ার্স ধ্বনিতে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বাতাসে মিলিয়ে দেন।

সাংবাদিকরা যে ধোয়া তুলসি পাতা এমনটা দাবি করছি না। মাটিতে পা পড়ে না এমন জার্নালিস্টের সংখ্যা নেহাতি কম না। তেলবাজিতে বিশেষ দক্ষতায় অনেকে যে আঙ্গুল ফুলে বট গাছ (কলা গাছে পোসায় না) বনে গেছেন তার প্রমাণ ঢের। তবে এটাও সত্যি যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে জবাবদিহিতার জায়গায় গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীর যে ভূমিকা তা অন্য যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা ব্যক্তির তুলনায় অগ্রগণ্য। আপনি ভাবতেই পারেন সুযোগ পেয়ে নিজ পেশার গুণকীর্তন করছি। আমি সেটা অস্বীকারও করতে চাই না। তবে আমার দাবি একটু ভেবে দেখার আহ্বান জানাতে চাই। সমাজে একই পেশার মানুষের মাঝে আবার কতো বৈষম্য বিদ্যমান। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে আমরা যে নজরে দেখি স্কুল শিক্ষককে সেভাবে মূল্যায়ন করি না। কিংবা মূল ধারার সাংবাদিকে আমারা যতটা গুরুত্ব দিই মফস্বলের সাংবাদিকে পাত্তাই দিই না। অথচ কমবেশি সাবাই জানি জেলার সংবাদদাতারাই গণমাধ্যমের প্রাণ। এক্ষেত্রে যার বৈভব যত বেশি তার সাফল্য তত ঈর্ষণীয়।

স্কুল শিক্ষকদের বেলাতেও তাই। যতদিন আপনি প্রাইমারি মাস্টারদের যথাযথ মর্যাদা-মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হবেন ততদিন আপনি উন্নত জাতির তকমাও পাবেন না। সহজ শর্তে উন্নত রাষ্ট্রের কাছ থেকে বড় ঋণ হবে আপনার টিকে থাকার অবলম্বন। কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা লেখা নজরে আসে। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজে সংগৃহীত উল্লেখ করে লেখাটা আপ করা হয়েছে। সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ‘সম্মানজনক পেশা’ বলেতে কি কিছু আছে? উত্তরে লেখক বলছেন আসলে পেশার কারণে কেউ সম্মানিত বা অসম্মানিত হতে পারে না। সম্মান আসে জ্ঞান, চরিত্র আর সততায়।

আপনি একজন কাস্টমস অফিসার বা যে কোন অফিসের একজন অফিসার। আপনি দু’হাতে ঘুষ খান। মানুষ কি আপনাকে সম্মান করবে? ডাকাতের সামনে কেউ যদি হাতজোড় করে দাঁড়ায়, কেউ কি বলবে যে-সে ডাকাতকে সম্মান করছে? আপনি একজন শিক্ষক। কিন্তু আপনার জ্ঞান জোড়াতালি মার্কা, আপনি ভালো পড়াতে পারেন না, কিংবা পড়ান না-ছাত্ররা আপনাকে সম্মান করবে? করবে না। পরীক্ষায় ফেলের ভয়ে বড়জোর তারা আপনাকে তোয়াজ করবে। অর্থাৎ অর্থকারী পেশা মানেই সম্মানজনক পেশা নয়। পেশা হলো জীবনধারণের প্রয়োজনে ব্যয় নির্বাহের উপায় মাত্র। মানবিক দিক থেকে দুনিয়ার সব মানুষের মর্যাদা সমান।

ধরেন একজন দলিত, তো তাঁর পেশাকে কি আপনি খুব অসম্মানজনক মনে করেন? যদি করেন, কেন? আপনার কি টয়লেট-বাথরুম পরিষ্কার করতে হয় না? কিংবা আপনি কি নিজেকে পরিষ্কার করেন না। তখন কি আপনি অসম্মানিত হয়ে পড়েন? কাউকে না ঠকিয়ে, বৈধভাবে অর্জিত যেকোন জীবিকাই সম্মানের। এখানে ছোট্ট একটা গল্প শেয়ার করতে চাই। তখন আমি অন্য এক টিভিতে শ্রম দিই। একদিন কথায় কথায় সিনিয়র এক সাংবাদিক আমাকে বলেন শোন কর্মই হচ্ছে ধর্ম। অর্থাৎ আমরা যদি যার যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করি তাহলে সেটাই প্রার্থনা।

যেমন বাবা-মাকে দেখভাল করা প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব। কেউ যদি সেটা পালন করে তাহলে সে স্রষ্টার সন্তুষ্টিও অর্জন করে। এই পথে নিজের উন্নতি-প্রশান্তির পাশাপাশি দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি অনিবার্য। আসলে সমাজে সবাই সবার ওপর নির্ভরশীল। কাউকে ছাড়া কারো চলে না। তাই কারো সাথে অন্যায়-অনিয়ম করার আগে একবার নয় শতবার ভাবুন। কেননা আপনি যদি কাউকে ইট মারেন তবে পাটকেলের আঘাত অবধারিত। অবশ্য তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে না গেলে এসব কথায় চিড়ে ভিজবে না। কবির ভাষায়-এসব মন্ত্রে জাগে না হৃদয় লাগে যেন পরিহাস।