বছরের সেপ্টেম্বর মাস। এখন পর্যন্ত যেন নগরবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় আতংকের নাম ডেঙ্গু। যেই আতংকের সাথে লড়াই করে কেউ পার পেয়ে যায়, কেউ আবার জীবন হারায়।
আর সেই তালিকায় যোগ হয়েছে দুই ভাই–বোনের নাম। দেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৭ দিনের ব্যবধানে বিদায় নিয়েছেন একই পরিবারের ফুটফুটে দুই সন্তান।
ডেঙ্গু! যা এবছর যেন দেশবাসীর কাছে কোন মহামারীর থেকে কম নয়। কারন এ বনছর বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ এবং মৃত্যুর সংখ্যা। শহরের পাশাপাশিপাশি পার্বত্য এলাকা এবং গ্রামেও রয়েছে এর বিস্তার।
ফলাফলস্বরুপ ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এতই ভয়ানক হয়ে দাড়িয়েছে, যা গেল কয়েক বছরের মধ্যে মানুষ কখনও দেখেননি। আর তাইতো এর প্রকোপ থেকে বাঁচতে জনসাধারণ মরিয়া হয়ে আছেন। কিন্তু তবুও যেন মিলছে না নিস্তার।
‘আব্বু ঢাকায় অনেক মশা, ঢাকায় থাকবো না’-এমনই কথা ভেষে বেড়াচ্ছে গণমাধ্যমে। কথাটি বলেছিল এক অসহায় বাবার ফুটফুটে সন্তান। কারন মশার কামড়েই যে ভাইকে হারিয়েছিল এক সপ্তহ আগে।
তাই বারংবার বাবার কাছে সন্তানের আবদার, থাকবে না নগরে। কিন্তু সেই আবদার রাখতে পারলেন না মা–বাবা কেউই। কারন এর আগেই যে সেই সন্তান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিদায় নিয়েছে দুনিয়া থেকে।
দুই সন্তানকে হারিয়ে এখন নিঃস্ব বাবা–মা। জীবন থেকে যেন বেঁচে থাকার আশা ফুরিয়ে গেছে মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পত্তির। গত ১৬ আগস্ট প্রথমে ৯ বছরের ছেলে আরাফাত জাহান রাউফের ডেঙ্গু ধরা পড়ে।
গত১৪ আগস্ট আরাফাতের হালকা জ্বর আসে। ১৫ আগস্ট এলাকার এক চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়। ১৬ আগস্ট রক্তের পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসে।
ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর থেকে দ্রুত প্লাটিলেট কমতে থাকে তাদের বড় সন্তানের। কিন্তু চিকিৎসক বলেছিলেন, হাসপাতালে নেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু পরের দিন ১৭ আগস্ট প্লাটিলেট দ্রুত কমতে থাকে।
১৮ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি করার আগেই আরাফাত মারা যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা জানান, ছেলে মারা গেছে। ভাইয়ের মৃত্যুর পর অসুস্থ হয়ে পড়ে বোন ইসনাত জাহান রাইদা।
জ্বর আসার পরেই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। রেন্ট–এ–কার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইব্রাহিম জানালেন, ধানমন্ডির একটি হাসপাতালের পিআইসিইউতে মেয়েকে পাঁচ দিন রেখে মেয়ে ভালো আছে বলে বাসায় আনতে বলে।
তবে মেয়েকে বাসায় আনার পরই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন মহাখালীর আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালের পিআইসিইউতে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতাল তিন লাখ টাকা দিয়ে সাতটি ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলেছিল। দুটি ইনজেকশন দেওয়াও হয়। কিন্তু বাবা–মার শেষ সম্বল ৬ বছর বয়সের রাইদাও ২৫ আগস্ট সকালে না ফেরার দেশে চলে যায়।
দুই সন্তানের আকস্মিক মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না বাবা–মা। সাজানো গোছানো সংসারজুড়ে শুধু সন্তানদের স্মৃতি। তাই রাজধানীর মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ার বাসা ছেড়েছেন তারা।
জানা গেছে, রাজধানীর আইকন একাডেমি নামে একটি স্কুলে রাউফ কেজি আর রাইদা নার্সারিতে পড়ত। শ্রেণি শিক্ষকদেরও চোখের মণি ছিলো দুই– ভাইবোন। স্কুলের দুই শিক্ষার্থীর এমন মৃত্যুতে শিক্ষকরাও শোকাহত।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু আর আক্রান্তের রেকর্ড হয়েছে চলতি আগস্ট মাসে। এ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৩৪২ জন। আর চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট মারা গেছে ৫৯৩ জন।
এদিকে ডেঙ্গুতে জ্বর ছেড়ে গেলেও মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন আক্রান্তরা। বিশেষজ্ঞদের ধারনা, একাধিক স্ট্রেইন দ্বারা যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের মধ্যে জটিলতাটা বেশি হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক ডা. বে–নজির আহমেদ বলেন, এটা শুধু বয়স্ক মানুষ, যাদের আগে থেকেই রোগ আছে তাদের হচ্ছে এমনটা না। ইয়াং মানুষ যাদের অন্য রোগ নেই তাদেরও হচ্ছে। এতে আমার ধারনা, একধিক স্ট্রেইন দ্বারা যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের মধ্যে জটিলতাটা বেশি হচ্ছে।
ডেঙ্গু থেকে সহসাই মুক্তি মিলছে না জানিয়ে বে–নজির আহমেদ বলেন, জনসচেতনতায় সরকারি সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
Leave a Reply