বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে সম্মিলিতভাবে

ইদানীং পত্রপত্রিকায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের খবর যখন আমাদের আশান্বিত করে তুলছিল, তখন এই ৪৫ জন ছাত্রীর বিয়ের কারণে পরীক্ষায় না বসার খবরটি আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না।

শুক্রবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক খবরে বাল্যবিবাহের কারণে এই ৪৫ জন ছাত্রীর পরীক্ষায় না বসার বিষয়টি জানা যায়। খবর অনুযায়ী, এই ছাত্রীরা যেসব স্কুলে এত দিন পড়ালেখা করে আসছিল, সেসব স্কুলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নিয়মিত নানা সচেতনতামূলক সভা করা হয়। শ্রেণিকক্ষে বাল্যবিবাহের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ছাত্রছাত্রীদের ধারণা দেওয়া হয়। কিন্তু এসব উদ্যোগ যে খুব একটা কাজে আসেনি, ৪৫ জন ছাত্রীর বাল্যবিবাহের শিকার হওয়াই তার প্রমাণ।

তাহলে করণীয় কী? চলতি বছরেই দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইন হয়েছে। তবে ওই আইনের একটি বিশেষ বিধান অনুযায়ী, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশে এবং পিতা-মাতা বা অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বাল্যবিবাহ হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। হতে পারে এই ৪৫ জন ছাত্রীর অভিভাবকেরা ওই বিশেষ বিধানের সুযোগ নিয়ে তাদের বাল্যবিবাহ দিয়েছেন।

আমরা মনে করি, কোনো অবস্থায়ই বিয়ের বয়সের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া যাবে না। জরুরি ভিত্তিতে এ আইনটি সংশোধন করা হোক। এর পাশাপাশি ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মধ্যে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তাঁদের জন্য নিয়মিত আলোচনা সভার আয়োজন করতে হবে, যেখানে তাঁরা বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানতে পারবেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো ও সুশীল সমাজের সদস্যরা এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারেন।

 বাল্যবিবাহ রোধের পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।

দুর্বৃত্তদের ধরুন, ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান

রংপুরের গঙ্গাচড়ার অঘটনটি হঠাৎ করেই ঘটেনি। মৃত খগেন রায়ের ছেলে টিটু রায় অবমাননাকর স্ট্যাটাস দিয়েছেন বলে ৫ নভেম্বর গঙ্গাচড়া থানায় মামলা করেছিলেন একজন। তাহলে পুলিশ কেন ঘটনাটি দ্রুত তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিল না? তারা আগেভাগে ব্যবস্থা নিলে হয়তো সেখানকার হিন্দু পরিবারের বাড়িঘরগুলো পুড়ত না। অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ লোকদের ঠেকাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে একজন নিরীহ মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাও দুঃখজনক।

এর আগে ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে, ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ফেসবুকে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে স্ট্যাটাস দিয়ে দুর্বৃত্তরা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে। তারা রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এবং নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে ও জ্বালিয়ে দেয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কোনো ঘটনায় এখন পর্যন্ত অপরাধীরা শাস্তি পায়নি।

রংপুরের ঘটনাটি রহস্যাবৃত। সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিই ধর্মীয় অবমাননাকর কোনো স্ট্যাটাস দিয়েছেন, নাকি তাঁকে ফাঁসানোর জন্য কেউ এই দুষ্কর্ম করা হয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। কেউ ধর্মীয় অবমাননাকর কিছু করলে দেশের প্রচলিত আইনে তাঁর বিচার হবে। কিন্তু সেটিকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে কোনোভাবেই সম্প্রদায়বিশেষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া চলতে পারে না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। পাঁচ দিন আগে দায়ের করা মামলার তদন্তের আগেই কেন হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলো? এর পেছনে মহলবিশেষের উসকানি আছে কি না, সেটিও দেখার বিষয়।

এলাকার পরিস্থিতি থমথমে। বিশেষ করে আক্রান্ত হিন্দু পরিবারগুলো ভয়ভীতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারের দায়িত্ব তাদের নিরাপত্তা দেওয়া। যাদের ঘরবাড়ি পোড়ানো হয়েছে, তারা এখন খোলা আকাশের নিচে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। অবিলম্বে তাদের ঘরবাড়িগুলো পুনর্নির্মাণ করে দেওয়া প্রয়োজন।

আমরা পুরো ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং অপরাধীদের শাস্তি দাবি করছি। কেউ ধর্মীয় অবমাননাকর কিছু করলে আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। কিন্তু তাই বলে ধর্মের নামে সম্প্রদায়বিশেষের ওপর সংঘবদ্ধ হামলা এবং তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া বরদাশত করা যায় না। অপরাধী যে-ই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে।

নারীদের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা

তবে ঘটনা প্রকাশের পর উপজেলা ছাত্রলীগ তাৎক্ষণিকভাবে আরিফকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু এ ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে, আইসিটি আইনে হয়নি। আর এখন পর্যন্ত আরিফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আমরা চাই, পুলিশ দ্রুত তাঁকে গ্রেপ্তার করুক।

নারীদের ফাঁদে ফেলে সুযোগ নেওয়ার প্রবণতা বা এ ধরনের বিকৃতি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম ও স্মার্টফোনের কল্যাণে এসব যেন অনেক পুরুষের কাছে ডালভাত হয়ে গেছে। ইদানীং এর মাত্রা বেড়ে গেছে, একটি ঘটনা যেন আরেকটি ঘটনাকে উসকে দিচ্ছে।

কথা হচ্ছে সভ্যতার কিছু রীতিনীতি ও মানদণ্ড আছে, সমাজের মানুষকে তা মেনে চলতে হয়। তা না হলে সমাজে নৈরাজ্য দেখা দেয়। এই শিক্ষা লাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে পরিবার, তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে মানুষ একধরনের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। এই বন্ধন আলগা হয়ে গেলে অপকর্ম করতে মানুষের বাধে না। এ ছাড়া সমাজে সুস্থ বিনোদনের অভাব আছে। একসময় পাড়া-মহল্লায় খেলার ও নাটকের ক্লাব ছিল, স্কুলে গ্রন্থাগার ছিল। এখন ওসবের বালাই নেই, যার অভাবে মানুষের সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেটের গঠনমূলক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সমাজে নীতি, নৈতিকতা ও সামাজিকতার শিক্ষা থাকতে হবে। সর্বোপরি আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এসব করে কেউ পার না পায়। নারীরা এখন বাল্যবিবাহ রোধে এগিয়ে এসেছেন, ঘাসফুলের মতো সংগঠন হয়েছে, এবার এসব হয়রানি রোধেও নারীরা এগিয়ে আসতে পারেন। সমাজের সব সচেতন মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।

ঢাকার রাস্তাঘাটের দুর্দশা

ডিএসসিসি সরকারের কাছে টাকা চেয়েছে ১৫৮ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করার জন্য। সংস্থাটির দাবি হলো এই সড়কগুলো বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় সড়কের ক্ষতি হয়েছে এ কথা সত্য, কিন্তু পুরো সত্য নয়। সড়কগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেও আগেভাগেই ভেঙেচুরে গেছে। অনেক সড়ক মেরামতের সময় অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সেগুলো টেকসই হয়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ির ফলেও অনেক ভালো সড়কের ক্ষতি হয়েছে। নগরের অনেক এলাকার বাসিন্দাদের একটা সাধারণ অভিযোগ, ‘এই ভালো রাস্তাটা খুঁড়ে নষ্ট করা হয়েছে।’

সুতরাং শুধু বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতার কারণ দেখিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামতের জন্য সরকারের কাছে অর্থ চাওয়া হলেও এমন নিশ্চয়তা মিলবে না যে সরকারের দেওয়া অর্থের সদ্ব্যবহার হবে। প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে সড়ক মেরামতের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি হবে না; মেরামতকাজের গুণগত মান নিশ্চিত করা হবে যেন তা টেকসই হয় এবং অল্প দিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে না যায়। যেসব সড়ক মেরামতের জন্য সরকারের কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এমন অনেক সড়কও আছে যেগুলো এক বা দুই বছর আগেই মেরামত করা হয়েছে।

সুতরাং এটা নিশ্চিত করতে হবে যে সড়কগুলোর মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে কোনো গাফিলতি, অনিয়ম, দুর্নীতির সুযোগ থাকবে না। কোনো সড়ক তার স্বাভাবিক মেয়াদের আগেই নষ্ট হলে সেটি নির্মাণ বা মেরামতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনীয় পাথর-বালুর পরিবর্তে শুধু আলকাতরার প্রলেপ বুলিয়ে সড়ক মেরামতের অভিযোগ বিস্তর পাওয়া যায়, কিন্তু এ ধরনের অপরাধের জন্য কখনো কারও শাস্তি হয় না।

ডিএসসিসি সরকারের কাছে আরও প্রায় ২৫৭ কোটি টাকা চেয়েছে ৮০ কিলোমিটার ফুটপাত, ১৬৬ কিলোমিটার নর্দমা এবং সোয়া ৫ কিলোমিটার সড়ক বিভাজক মেরামত ও নতুন করে নির্মাণ ও উন্নয়নকাজের জন্য। এ বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য: সরকারের অর্থের সদ্ব্যবহার করতে হবে।

নাগরিকদের দুর্ভোগের কথাটিও মনে রাখুন

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ সভা–সমাবেশ করে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে তাদের নীতি ও কর্মসূচির কথা জানাবে, এটাই নিয়ম। সে ক্ষেত্রে কোন দল ক্ষমতায় আছে আর কোন দল ক্ষমতার বাইরে, সেটি দেখা প্রশাসন তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব নয়। তাদের দায়িত্ব শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং জনগণের জানমালের হেফাজত করা।

সেই বিবেচনায় গত রোববার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশটি যে ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছে, সে জন্য দলের নেতারা ধন্যবাদ পেতে পারেন। দুই বছর পর অনুষ্ঠিত এই সমাবেশ ছিল বিএনপির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আগেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন সমাবেশকে কেন্দ্র করে কোনো অঘটন ঘটলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ না করা সত্ত্বেও ঢাকার প্রবেশপথ ও শহরের বিভিন্ন সড়কে বাস চলাচল বন্ধ রাখা কেবল অস্বাভাবিক নয়, বেআইনিও। মালিকেরা বাস নামাননি বলে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে সাফাই গাওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা কার ইঙ্গিতে কাজটি করেছেন, সেটি খতিয়ে দেখা জরুরি। বিরোধী দলের কর্মসূচি থাকলেই বাস-ট্রেন-লঞ্চ বন্ধ করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার কুঅভ্যাসটি ত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়।

বিএনপি রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য করতে পারে বলে সরকারের তরফে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসা হচ্ছে। রোববারের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ তেমন আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করেছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক দলেরই কর্তব্য শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন। এ কারণে আমরা বরাবর হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক রাজনীতির বিরোধিতা করে আসছি। কোনো অবস্থায়ই জনগণের জানমালের ক্ষতি হয় কিংবা তারা দুর্ভোগে পড়ে, এ রকম কর্মসূচি নেওয়ার সুযোগ নেই।

তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এও মনে রাখতে হবে যে, ভয়াবহ যানজটে আক্রান্ত রাজধানীতে আহূত সমাবেশ যত শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলই হোক না কেন, জনদুর্ভোগ এড়ানো যাবে না। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া কোনো সমাবেশ করা উচিত নয়। বিকল্প হিসেবে তারা পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট সমাবেশ করতে পারে। আর আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে রাস্তা বন্ধ করে ঘন ঘন সমাবেশ করারই বা কী প্রয়োজন? জনগণের করের পয়সায় চালিত রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও বেতার যদি সরকারি দলের মুখপত্র না হয়ে সব দলের বক্তৃতা–বিবৃতি প্রচার করে, তাহলে সমাবেশের প্রয়োজনীয়তা অনেকখানি কমে যাবে।

দুর্নীতিবাজ চক্রের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে

এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বছরে ছয়টি উৎসবভাতা নেন, উপরন্তু নানা ধরনের সম্মানী ভাতা বাবদ তাঁরা চলতি বছর ইতিমধ্যে ২৭ লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা নিয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একটি অংশ পাঠ্যবই মুদ্রণ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে অবৈধভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। দরপত্র আহ্বানের আগেই তাঁরা প্রাক্কলিত দর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেন; সেই সব প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে দরপত্র জমা দেয়। অর্থাৎ তাঁদের সহযোগিতায় একটা সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যাঁরা দরপত্র-প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতার নীতিকে অর্থহীন করে দিয়েছেন। এনসিটিবির কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বেনামে মুদ্রণ-প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন, যেসব প্রতিষ্ঠান পাঠ্যবই ছাপার কাজ পায়। অবৈধ আর্থিক লেনদেনের ফলে নিম্নমানের কাগজে ছাপা পাঠ্যবই ‘সন্তোষজনক’ ছাড়পত্র পায়; মুদ্রণ-প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ছাপা বই জমা দিতে ব্যর্থ হলেও এনসিটিবির প্রতিবেদনে বলা হয়, সঠিক সময়ে বই পাওয়া গেছে।

এনসিটিবির এসব অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে বছরের পর বছর ধরে; এটা একটা সংঘবদ্ধ ও নিয়মিত ব্যবস্থা, যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা টিআইবির প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে প্রথম আলোকে বলেছেন, এ ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করণীয় কী, তা তাঁরা পরে জানাবেন। এটা দায়সারা বক্তব্য; এই মাত্রার অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করণীয় নির্ধারণের দ্বিধাদ্বন্দ্বের সুযোগ নেই। তাঁর প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে নজরদারি করলে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়মিত চর্চায় পরিণত হতে পারত না।

পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক, দলীয় বা ভাবাদর্শগত দিকে যেসব অভিযোগ টিআইবির প্রতিবদনে তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ বিষয়ে সরকারের নীতিগত ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হতে পারে, কিন্তু পাঠ্যবই প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণের প্রক্রিয়ায় আর্থিক দুর্নীতি ফৌজদারি অপরাধ এবং তা চলে আসছে সংঘবদ্ধভাবে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে। এটা কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না। শুধু এনসিটিবির প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নয়, এই অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিকার করা ও তা চিরতরে বন্ধ করার জন্য ফৌজদারি আইন প্রয়োগ করা উচিত।

দুষ্কৃতকারীদের বিচার করতে হবে

ইজারাদাতার মাছ ছাড়ার অধিকার ছিল কি ছিল না, সে প্রশ্ন ভিন্ন। অথচ যখন জানতে চাওয়া হয়েছে, তখন ইজারাদাতার মেয়াদ যে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, সেটাই কেউ কেউ বড় করে দেখিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ যদিও নিশ্চিত করেছে যে ইজারার সময় পেরিয়ে যাওয়ার কারণে ইজারাদাতাকে মাছ তুলে নেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা ইজারাদারকে ‘ভাগ’ দিতে চাপ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে, কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, তা বিবেচনায় রেখে সুষ্ঠু তদন্ত করা। প্রায় ১২ লাখ টাকা মূল্যের মাছ হত্যার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের শাস্তি পাওয়া দরকার। তাঁদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা দরকার।

আমরা বিশ্বাস করি, পরিবেশের প্রতি সচেতনতা বাড়ানো এবং সমাজে দৃষ্টান্ত তৈরির স্বার্থে শুধু পুলিশ বিভাগ নয়, পরিবেশ অধিদপ্তরও এর তদন্তে এগিয়ে আসতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি, বিষপ্রয়োগের সঙ্গে জড়িত দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করা কঠিন নয়। আমাদের প্রত্যাশা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সব স্তরের সদস্যদের মধ্যে যাতে এ ধরনের অপরাধকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার মনমানসিকতা তৈরি হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্ভাব্য বিপন্নদের তালিকায় আমাদের দেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেও এ বিষয়ে জনসচেতনতা দুঃখজনকভাবে আর দশটা বিষয়ের মতো এখানেও মামুলি রয়ে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি, পরিবেশ–সংক্রান্ত যেকোনো অপরাধের তদন্ত ও তার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নৌমন্ত্রী

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিবিএর আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া ক্রমেই গতিলাভের ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। সংকীর্ণ দলাদলি, উপদলীয় কোন্দল এবং হানাহানিযুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এমনিতেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি মানুষের মধ্যে থাকা প্রয়োজন।

শ্রমিকনেতা হিসেবে শাজাহান খানের ভূমিকার কারণে আজ তা হুমকিগ্রস্ত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। জাসদের রাজনীতিতেও তিনি শ্রমিকনেতা ছিলেন। তাই তিনি নিজেই সাক্ষ্য দেবেন, অতীতে কখনোই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিবিএ নেতাদের কোনো সমাবেশে এভাবে রীতিমতো কাগজে-কলমে ‘বিরোধী দলকে শায়েস্তা’ করতে যুক্ত করা হয়নি।

এটা পরিহাসজনক যে নৌপরিবহনমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন, তা কার্যত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। তিনি যেন ভুলে গেছেন তাঁর দলই সরকারে এবং যেকোনো নাশকতা, তা যে যখনই করুক না কেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। আর তার বিচার করা সরকারের স্বাভাবিক কর্তব্য। আমরা অবশ্যই অভিযোগ অনুযায়ী বিএনপি-জামায়াতের দ্বারা সংঘটিত ২০১৩-১৪ সালের অগ্নিসংযোগ ও হত্যার তদন্ত এবং বিচার আশা করি। আর সরকারকে যদি এ জন্য একান্ত চাপ দিতেই হয়, তাহলে সে জন্য আওয়ামী লীগের অন্য বহু অঙ্গসংগঠন রয়েছে। তাদের শক্তি-সামর্থ্য এতটা কমে যায়নি যে এখন স্বায়ত্তশাসিত এবং সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মচারীদের এ কাজে ব্যবহার করতে হবে।

তাই এই আশঙ্কা অমূলক নয় যে আগামী সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে এর যোগসূত্র থাকতে পারে। তার থেকেও ভয়াবহ যে দিকটি লক্ষণীয় তা হলো, ব্যাংক খাতে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর সে জন্য রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি খাতের ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগকে চিহ্নিত করা হয়। এমন একটি বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে নৌমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ব্যাংকিং-সংশ্লিষ্ট লোকজন প্রমাদ গুনছেন।

বিষয়টিকে বিচ্ছিন্নভাবে একজন উচ্চাভিলাষী মন্ত্রীর খেয়াল-খুশি হিসেবে দেখার সুযোগ কম। এবার যা ঘটল, তার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও পরিচালনা পর্ষদকেও নিতে হবে। কারণ, সিবিএর কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক নেতাদের যাতায়াত খরচ বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল থেকে বহন করা হয়েছে এবং সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে কর্মক্ষেত্রে তাদের ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জযোগ্য কি না, তা-ও প্রশ্নের বাইরে নয়।

আমরা মনে করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, স্বায়ত্তশাসন ও তার মর্যাদার প্রতি  শ্রম অধিকার–বহির্ভূত যেকোনো পদক্ষেপকে প্রতিরোধ করা উচিত।

অবহেলিত রেলওয়ে

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় অনুমোদিত ৩ হাজার ১৭১ জনবলের বিপরীতে বর্তমানে ২৮টি উপকারখানায় (শপ) কর্মরত আছেন ১ হাজার ২০৪ জন শ্রমিক-কর্মচারী। অর্থাৎ জনবল ঘাটতি ১ হাজার ৯৬৭ জন। অনেকে কমিশন পাওয়ার আশায় দেশে যন্ত্রপাতি না বানিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করতে বেশি উৎসাহী।

কোনো কারখানা কি দুই-তৃতীয়াংশ পদ খালি রেখে চলতে পারে? কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে বলে কথা। আড়াই দশক আগে রেলওয়েতে সোনালি করমর্দনের মাধ্যমে রেলওয়ের লোকবল কমানো হয়েছিল। সেটি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত—মাথাব্যথা সারানোর নামে মাথা কেটে ফেলা।

রেলওয়ের প্রতি আগের সরকারগুলোর অবহেলা এতটাই প্রকট ছিল যে তারা মন্ত্রণালয়টি তুলে দিয়ে একটি বিভাগে রূপ দিয়েছিল। এখন আলাদা রেলপথ মন্ত্রণালয় হলেও আগের বদভ্যাস কাটাতে পারেননি রেলওয়ের পদাধিকারীরা। যেখানে একটি কারখানায় অনুমোদিত জনবলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পদ খালি, সেখানে রেলওয়ের উন্নয়নে সরকার আগ্রহী দাবি করা হাস্যকর। প্রতিবেশী ভারতে যখন রেলপথের সেবা বাড়ানো হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে রেলওয়ে সংকুচিত করা আত্মঘাতী ছাড়া কিছু নয়।

রেলওয়ের আয় বাড়াতে হলে এর যাত্রীসেবার মানের পাশাপাশি রেলপথের দৈর্ঘ্যও বাড়াতে হবে। বর্তমানে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় সীমিত লোকবল দিয়ে মাসে যদি গড়ে ২৬টি কোচ ও ২৫টি মালবাহী ওয়াগন মেরামত এবং প্রায় ১ হাজার ২০০ রকমের যন্ত্রাংশও তৈরি সম্ভব হয়ে থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় লোকবল থাকলে অনেক বেশি কোচ-ওয়াগন মেরামত ও যন্ত্রাংশ তৈরি করা সম্ভব হতো। দেশে এসব রেলওয়ে সরঞ্জাম তৈরি হলে রেলওয়ে যেমন স্বাবলম্বী হবে, তেমনি মানুষের কর্মসংস্থানও হবে।

অবিলম্বে সৈয়দপুর কারখানায় অনুমোদিত পদে লোক নিয়োগ করে এর উৎপাদন বাড়ানো হোক। রেলওয়েকে স্বাবলম্বী করতে হলে এর বিকল্প নেই।

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করুন

বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে অগ্নিসংযোগের দায়ে যে ২৯ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং সিলেটের মহানগর বিচারিক হাকিম আদালত যাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই অগ্নিসংযোগের ঘটনার সময় সরকারপন্থী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ছিলেন, অন্যরা সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। উল্লেখ্য, ঘটনার পরপরই ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুই কর্মী ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে আদালতে দুটি পৃথক নালিশি মামলা করেছিলেন; আর ছাত্রাবাসটির তত্ত্বাবধায়ক শাহপরান থানায় মামলা করেছিলেন অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে। এই তিনটি অভিযোগ একীভূত করে আদালত পুলিশকে ঘটনা তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পুলিশ ও সিআইডি দুই দফায় তদন্ত করে, তারপর অধিকতর তদন্ত করে পিবিআই। ওই সব তদন্তেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ বলে তাঁদের অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা হয়।

পুলিশের এই তিনটি সংস্থার ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হয় এবং এর ফলে ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগকারীদের পরিচয় বেরিয়ে আসে। এটা এখন স্পষ্ট যে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তৃপক্ষগুলোর কথিত তদন্তে সত্য উদ্‌ঘাটনের দায়িত্ব এড়ানো হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে। রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের বিচার করার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ক্ষমতাসীন দল কিংবা তাদের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ছাড় দেয়—সিলেটের এ ঘটনা তার একটা সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত।

কিন্তু এই চর্চা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এর ফলে আইনের শাসন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে, বিচারহীনতার পরিবেশ পরিব্যাপ্ত হচ্ছে এবং অপরাধ করে শাস্তির ঊর্ধ্বে থাকা যায় এমন ধারণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতির পক্ষেই ক্ষতিকর হচ্ছে না, পেশাদার অপরাধবৃত্তি প্রসারের পথও খুলে দিচ্ছে। অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হচ্ছে।

এসবের অবসান ঘটানো দরকার। শুধু দেশের স্বার্থে নয়, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির স্বার্থেও। ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগের দায়ে যে ২৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, তাঁরা এখন যেখানেই থাকুন, যে সংগঠনই করুন না কেন, সবাইকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক।